অনেকক্ষণ অপেক্ষা করল সে। দুচোখ ভরে হৈচৈ দেখল মেয়েদের। দেখতে দেখতে কখন যে এদের মধ্যে ডুবে গিয়েছিল তা বীথি নিজেও বলতে পারবে না।
বেয়ারা এসে খবর দিল, আবুকে পাওয়া যাচ্ছে না।
দূরে সোনালি জমিনে ছোট ছোট লাল ফুল ভোলা শাড়ি পরা একজন পাউরুটি চিবোচ্ছিল। নামটা শুনে সে ওখান থেকেই বীথিকে যে মেয়েটি নিয়ে এসেছিল তাকে শুধালো, কাকে খুঁজছিস?
আবুকে। উনি ওর বোন।
মেয়েটি তখন হাতের পাউরুটি পিরিচে রেখে রাণীর মতো এগিয়ে এলো তার কাছে। বীথি মুগ্ধ হলো। এত ভালো লাগল, চোখ ভরা খুশি নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। মেয়েটি বলল, আবুকে বুঝি খুব দরকার। ওকে কি পাওয়া যাবে? ও আজ বিকেল চারটেয় আমাদের বাসায় আসবে।
বীথি চকিতে মুখ তুলে তাকালো খুব সরাসরি করে।
আমি ওকে বললে চলবে?
একটু ইতস্তত করে বীথি উত্তর করল, বলবেন হাশেম ভাই এসেছেন আজ। বেশি রাত যেন না করে।
বলে বেরিয়ে আসে বীথি। কেন যেন মনটা খুব ভার হয়ে গেছে। কারণ খুঁজে পায় না। তাড়া দেয় রিকশঅলাকে। হাশেমের কথা মনে পড়ে। আর বকুল। কেমন ছিল দেখতে?
হাশেম ভাই বুঝলো কী করে, মনে মনে তার এত কষ্ট যে কষ্টের পরিমাপ করতে গিয়ে সে নির্বাক হয়ে গেছে?
সোনালি জমিনে ছোট ছোট লাল ফুল–তোলা শাড়ি। বকুলের কথা ভাবতে গিয়ে, বীথির চোখে এই মেয়েটির মুখ ভেসে উঠতে চায়।
আনমনে হাসলো সে। বকুলকে নিয়ে বড্ড বেশি ভাবছে না কি?
.
আজ সকাল থেকে আবুর দিনটা কেটেছে যেন নেশা লাগানো এক ঘূর্ণির ভেতর দিয়ে। বীথির সেই অমন মাথা নাড়া, কিছুতেই রিহার্সেলে আসতে রাজি না হওয়া, মনটাকে একেবারে মৃত করে রেখেছিল।
বাসা থেকে বেরিয়ে সোজা ইউনিভার্সিটি এসেছিল আবু। এত সকালে এসে কোন দরকার ছিল না, তবু। এসে গুম হয়ে বসে রইলো মধুর দোকানে। তারপর যখন দেখল বিলকিসকে, উঠে দাঁড়াল তার সংগে দেখা করবার জন্যে।
লাইব্রেরীতে যাবে বলে আজ একটু ভোরে ভোরে এসেছিল বিলকিস। প্রচুর দিন কিস্সু পড়াশোনা হয়নি, মেলা বই, মেলা টিউটোরিয়াল পড়ে আছে। সেগুলো সারতে হবে। আবুকে দেখে বিস্মিত হলো সে।
শুধালো, কী ব্যাপার?
কিছু না। কিছু না।
চলে যাচ্ছিল আবু। বুঝল বিলকিস। বলল, কথা বলবেন? বাসায় আসুন না। একদিনও তো আসেন নি। আজ চারটের দিকে?
আচ্ছা।
চলি এখন। আজ আমি ভালো ছাত্রী।
বলে বিদ্যুত হাসিতে মুখ উদ্ভাসিত করে চলে গেছে বিলকিস।
আজ বিকেলে এই প্রথম বিলকিস আবুকে ডেকেছে তার বাসায়। কিন্তু এ নিয়ে এত ভাববার, মন এত প্রস্তুত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠবার কী কারণ থাকতে পারে, শাদা চোখে তার ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যাবে না।
যতই এগিয়ে এলো ঘড়ির কাঁটা বিকেল চারটের দিকে, ততই অস্থিরতা বেড়ে উঠলো আবুর। এমন হলো যে, বেলা বারোটা না পেরোতেই তাকে বেরিয়ে পড়তে হলে সবার সঙ্গ ছেড়ে, ইউনিভার্সিটি ছেড়ে, এমনকি একটা জরুরি টিউটোরিয়াল ক্লাশ পালিয়ে। দুপুরের রোদের মধ্যে খুব লম্বা করে হাঁটবার একটা প্রেরণা পেল। যেন এতকাল যার জন্যে প্রতীক্ষা তাকে হাতের কাছে পেয়ে পালাতে চায় আবু।
কিন্তু বিলকিস তো এমন কিছু রত্নমানিক আজ তাকে প্রতিজ্ঞা করেনি। ওই একটা দোষ আবুর। বিলকিসকে কিছুতেই সে যেন সহজ চোখে দেখতে পারে না।
বিলকিস হয়ত জিগ্যেস করল, কী কেমন আছেন?
ভালো।
কথাটা বলেই তার ভারী সাধ হয় বিলকিসের কাঁধ আলতো হাতে স্পর্শ করে, চোখের দিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করে, আর তুমি?
কিন্তু বলা হয় না। বিলকিসের সামনে বিমূঢ়ের মতো দাঁড়িয়ে থেকে সে মনে মনে প্রশ্নোত্তরের সম্পূর্ণ একটা খসড়া দেখতে পায়। যেন শুনতে পায় বিলকিস বলছে, আমিও ভালো। তারপর সে কল্পনা করে, বিলকিস একটা নীরব মুহূর্ত যেতে দিয়ে, ব্যথায় নীল হয়ে বলছে, ভালো আছি। কিন্তু শরীরের ভালো লাগা নিয়ে আমার গা জ্বালা করে, আবু। মন আমার ভরে উঠবে কবে বলতে পারো?
এ সব কিছুই হয় না। একটু পর আবু সত্যি সত্যি যে প্রশ্নটা করতে পারে তা হচ্ছে আপনি কেমন আছেন?
প্রশ্নটা উচ্চারণ করতে গিয়ে কণ্ঠে বারোয়ারি সুর ছাড়া আর কিছুই আনা সম্ভব হয় না। অতি মাত্রায় পোষাকী, সযত্নে বাঁচিয়ে চলা একটা দূর উচ্চারণ।
এই দ্বিধা নিয়ে, এই কিছু বলতে না পারা নিয়ে নিজেকে একেকদিন যাচ্ছে তাই বলে গাল দিয়েছে আবু। সে তিরস্কারের এক ভগ্নাংশও অন্য কাউকে করা হলে রক্তপাত হতে পারত। একেকদিন আবুর ইচ্ছে হয়েছে, নিজের আঙুল দাঁত কামড়ে রক্ত বার করে ফেলে।
একদিন খুব জেদ হয়ে গিয়েছিল আবুর। আজ সে বিলকিসকে নিয়ে যা হোক একটা কিছু করে বসবেই। হাতের তাস সোজা টেবিলের ওপর ফেলে দিয়ে বলবে, আমি তোমাকে ভালবাসি। এখন তুমি কী করবে বলো?
দিনটা ছিল ছুটির দিন।
বাথরুমে গিয়ে বালতি বালতি পানি ঢেলে নেয়ে ওঠে আবু। হাতের আঙুল চুপসে শাদা হয়ে যায়। তখন বেরিয়ে আসে। অস্থির পায়ে হাঁটতে থাকে বারান্দায়। মাকে দেখা যায়। বীথি পাশ দিয়ে চলে যায়। তবু কারো দিকে দৃষ্টি পড়ে না তার। হাঁটতে থাকে। বাগানে এসে বসে। আবার ঘরে যায়। এমনি করে অবশেষে একসময়ে বেরিয়ে আসে। তক্ষুনি রিকশা পাওয়া যায় না। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয় আবুকে। অনেকক্ষণ মানে দুমিনিট। সেই দুমিনিটে বিশ্বের রিকশাঅলা মনে মনে তার অভিসম্পাত কুড়িয়েছে।