বকুল?
অবাক হয়ে যায় আবু। এই মেয়েটা ও নাম জানল কী করে? পরে হেসে ফেলে ফিসফিস করে বলেছে, কাউকে বলবি না। হাশেম ভাই যে মেয়েটাকে ভালোবাসত তার নাম বকুল। বিয়ে হলো না কেন?
কী জানি। তুই নাম জানলি কী করে? জানিস বীথি, তোর মতো আমিও একদিন চুরি করে চিঠিগুলো পড়েছিলাম।
২. হাশেম জ্বরে কাঁপছে
হাশেম জ্বরে কাঁপছে হি হি করে। বীথি কম্বল এনে দিতেই সেটা গায়ে জড়িয়ে মরার মতো পড়ে রইলো।
মরিয়ম বললেন, তোর চাচাকে অফিসে একটা টেলিফোন কর, বীথি। আর তোর বড় চাচার বাসায় যাবি একবার?
পাশের বাড়িতে এসে চাচাকে টেলিফোন করল সে। মুরশেদ চৌধুরীর গলাটা কী অদ্ভুত শোনাল।
হাশেম ফিরেছে? কখন? রাস্কেলটা এতদিন ছিল কোথায় কিছু বলেছে? চাচার কথা বলার ধরনই ও রকম। পাছে মমতা চোখে পড়ে যায়, বাইরে তাই তম্বি। হাশেমের কাছে বীথি যে হঠাৎ নগ্ন হয়ে পড়েছিল সেই থেকে বুকের কাপুনিটা যাচ্ছে না; কাঁপা গলায় সে উত্তর করল, কিছু বলেনি। জ্বর এসেছে খুব।
আমি এক্ষুনি আসছি।
বীথি ফিরে এসে দেখে মায়ে ছেলের গলা সপ্তমে উঠেছে।
মরিয়ম বলছেন, এসেই পাগলামো শুরু করলি। এই জ্বর নিয়ে ঘরে যাবি না তো রাস্তায় পড়ে মরবি?
না, না, আমাকে কোথাও যেতে হবে না।
চল বাবা, ঘরে গিয়ে শুবি।
এখান থেকে আমি কোথাও নড়তে পারবো না।
মরিয়ম তার কম্বল ধরে টানলেন।
আহ ছাড়ো।
কম্বলটা প্রায় কেড়ে নিয়ে সোফায় কুণ্ডলি পাকিয়ে চোখ বুজে পড়ে রইল হাশেম।
একটু পর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, সবাই, সবাই এমনি করে। জড়িয়ে ধরে রাখতে চায়। কোথাও কি সুস্থির হয়ে থাকতে পেরেছি? যখন চলে যেতে চেয়েছি, দুঃখী সব। মানুষগুলো এসে বলেছে চলে যাবে? তাহলে আমরা বাঁচব কী করে? জানো মা, ওদের চোখের দিকে তাকালে মায়া লাগে। মনে হয়, ওদের বুকের শূন্যতা চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। আমার তো মায়া করলে চলে না। তাই পালিয়ে আসতে হয়েছে। দিনের পর দিন, এক গা থেকে আরেক গাঁ।
প্রতিটি নিঃশ্বাসের পর জ্বরের দাপটে হাঁপাতে থাকে হাশেম, তবু থামে না। কথাগুলো তাই বেদনার মতো শোনায়। হাশেম, না মরিয়ম না বীথি কেউ তাকে থামাতে পারে না, বলে চলে, আমি সবাইকে বলি, হতভাগা আমি কে যে আমাকে এমন করে মূল্য দিস? আমাকে অত ওপরে উঠিয়ে তোরা যে শেষে ঠকবি।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলে হাশেম—-কিন্তু তাকি কেউ বুঝতে চায়?
জ্বরটা বোধ হয় ভালো করেই এসেছে। বারবার করে বলে আর জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভেজাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে।
তা কি কেউ বুঝতে চায়। তা কি কেউ বুঝতে চায়। আমি একা যদি বিশ্বটাকে বাঁচাতে পারতাম, তাহলে আকাশের সেই সাত রাজার রাজা ব্যাটা আমাকে অমর আয়ু দিয়ে পৃথিবীতে পাঠাতেন রে। বীথি, তুই শুনছিস? তাহলে আমার দৃষ্টি হতো দীপ্তি। কোন খানে এতটুকু অন্ধকার রাখতাম না। সব আলো করে দিতাম। সব আমি আলো করে দিতাম। এখানে ওখানে আমাকে সারা রাত জেগে থাকতে হতো না।
জ্ঞান বোধ হয় হারিয়ে যাচ্ছে হাশেমের। মরিয়ম গিয়ে তাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরলেন, মাথায় বুলিয়ে দিলেন মমতার হাত। হাশেম একটুও বাধা দিল না।
মরিয়ম বীথির দিকে মুখ ফিরিয়ে বললেন, তুই যা, বীথি। পারিস তো আবুকেও ধরে আনিস।
বড় চাচাকে খবরটা দিয়ে বীথি এলো ইউনিভার্সিটিতে আবুর খোঁজে। আবু তো জানবে না, বীথি এসেছে হাশেমের সংবাদ নিয়ে। মনে করবে তার রিহার্সেল দেখতে এসেছে। মনে করে খুব খুশি হবে। আজ সকালে বড়ড বকেছিল আবু, সে যাবে না শুনে। বীথির ভয় করছিল, নাশতা কিছু না খেয়েই বুঝি বেরিয়ে যাবে তার ওপর রাগ করে। আশেপাশে ঘুরছিল তাই। যখন দেখেছে আবু খাবার টেবিলে বসে খাচ্ছে তখন স্বস্তি পেয়েছে। কী ভঙ্গি তার খাওয়ার যেন এক সংগে গোটা প্লেট মুখে পুরতে পারলে শান্তি। দেখে হাসি পেয়েছিল, কিন্তু তার সামনে হাসে নি, পাছে অনর্থ ঘটে। তাহলে আবু আর খেতোই না।
ইউনিভার্সিটিতে গেট পেরিয়ে হাঁটতে থাকে বীথি। কোনদিন আসে নি এখানে। বড় জড়সড় লাগছে। মনে হচ্ছে বিশ্ব তাকিয়ে আছে তার দিকে। মাথার পরে দুপুর রোদে ঝলসে আছে আকাশ। চমকে ওঠে হঠাৎ, হাশেমের সেই কথাটা মনে করে চমকে ওঠে বীথি। তুই এত কষ্ট পাস কেন?
হাশেম কী করে জানল, বীথির এত কষ্ট?—-যে কষ্টর কথা কোনদিন সে কাউকে বলতে পারেনি, যে কষ্ট সইতে না পেরে নিজেকে শান্ত করবার জন্যে একেকদিন তাকে কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে হয়েছে।
বুকের ভেতরে দুপ দুপ করতে থাকে বীথির।
কিন্তু কোথায় আবু? কোথায় গিয়ে তার সন্ধান নেবে? কার কাছে গিয়ে শুধোবে, আবুকে দেখেছেন?
করিডরে বিব্রত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বীথি। একটি মেয়ে পাশ কাটিয়ে যাচ্ছিল। তাকে অমন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধালো, কাউকে খুঁজছেন?
বীথি নাম বলল। বলল, সে তার বোন।
মেয়েটা ভাবল খানিক। পরে বলল, আসুন আমার সংগে।
বীথিকে সে নিয়ে এলো মেয়েদের কমনরুমে। সেখানে এককোণে গিয়ে বসলো সে। বেয়ারার হাতে একটা স্লিপ পাঠিয়ে মেয়েটা বলল, আপনি বসুন, লোক পাঠালাম খুঁজতে। রিহার্সেল নেই?
আছে, সে তো ছটার দিকে। এই তো কিছুক্ষণ আগেও আমাদের সঙ্গে ছিল। কেন, বাসায়। কিছু হয়েছে নাকি?
বীথি লজ্জা পেয়ে যায়। ভীরু চোখ তুলে বলে, না, না, এমনিতে দরকার।