কথাগুলো ভালো করে বুঝতে পারে নি বীথি। কম্পিত হাতে আরেকটা চিঠি সে খুলেছে।
কে বলেছে আমার হৃদয় প্রদীপের মতো? লোহা বলতে পারেন। আমাকে ডাকা মানে কষ্ট পাওয়া। আমার সান্নিধ্য খোজা মানে অভিশাপ ডেকে আনা। বন্ধুত্বের চেয়ে বড় কিছু চাইবার নেই পৃথিবীতে। কিন্তু সে পথেও যদি নিয়তি অমঙ্গল বিছিয়ে রাখে তো তা থেকেও বিমুখ হতে হবে।
চিঠি পড়ে বীথি বুঝতে পারে না, একটু একটু মনে হয়, বকুলকে কি নিজের হৃদয়ের কাছে ডেকেছিল হাশেম ভাই? কিন্তু কেন বকুল পারছে না তার ডাকে সাড়া দিতে? বকুল কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে হাশেমকে, এ কথা কোনদিন জানবে না বীথি।
পরের চিঠিটা কিন্তু আবার অন্যরকম। একেবারে নতুন কণ্ঠ নিয়ে বকুল কথা বলছে এই চিঠিতে।
আপনার অস্থিরতার জন্যেই বোধ হয় আপনাকে চেনা মনে হলো। আমার আবেগ গিয়ে এখন আছে স্থিরতা; অভাবনীয়তা গিয়ে এখন আছে অত্যন্ত আটপৌরে এক মন। এটা ছিল অনিবার্য। আমার রক্তের ভেতরে যেন বৈরাগ্য বাসা করে নিয়েছে। মানুষের মিছিলে আমার প্রিয়জন গেছে হারিয়ে আর আমি সমানে এগিয়ে চলেছি. দূরত্ব বৃদ্ধি করার দুরাশায়। আমি অদ্ভুতভাবে বিজ্ঞ। একটা অস্তিত্ব খায় দায় কথা বলে, আরেকটি সারাক্ষণ উদাস চোখ মেলে বসে থাকে। আমাকে কি সহ্য হবে?
কী হয়েছিল কে জানে, পরের চিঠিটায় বীথি দেখল, বকুল চটে গেছে। দুঃখ করেছে। দুঃখ পেয়েছে। নইলে অমন করে লিখতে যাবে কেন?
বলেছি ডাকবেন না। তাকে ভুল বুঝলেন কেন? মানুষকে যে অবিশ্বাস করে তার জন্যে নরকের দুয়ার সারাক্ষণ হাঁ করে আছে এই সত্য থেকে আমি মুক্তি খুঁজছিলাম। কিন্তু তার একমাত্র উপায় বোধ হয় মায়ার ভেতরে আশ্রয় নেয়া। অথচ কোনো মায়ার বন্ধনে পরাই এখন আর আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
ভেতরের একাকীত্ব কি কেউ ঘোচাতে পারে কখনো? আজ আমার বিশ্বাস হয়ে গেছে, আমার জীবন আর ফিরে আসবে না। রক্তহীন আত্মা, মরা ঘাসের রং আর ধূসর গুমোট আকাশ ছাড়া আর কিছুরই নাগাল যেন আমি পাবো না। তাই আবার আপনাকে সাবধান করছি আমি আমাকে ডাকবেন না, ডেকে পাবেন না।
এর পরের চিঠি লেখা অনেকদিন পরের তারিখে।
ঈশ্বরের আশীর্বাদে আজ কলম হাতে নিতে পেরেছি। এমন করে বিছানায় পড়ে গেছি, ভয় হয়। স্বাস্থের জন্যে মনে মনে চিরটা কাল যুদ্ধ করেও যখন এই অবস্থা হয়, তখন মনের জোর হারিয়ে ফেলি।
তোমার চিঠি পড়ে নিজেকে অভিশাপ মনে হচ্ছে। অনেক মানুষকে ভুগিয়েছি না জেনে। কারো কারো কষ্ট পাবার তীব্রতা দেখে সমব্যথায় মন আর্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এ দুঃখ লাঘব করা সম্ভব হয়নি। জানো তো, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হয় না। আমার নাক দিয়ে অসম্ভব রক্ত পড়ছে। চিন্তা করবার শক্তি নেই। শুধু এটুকু বলি আমার জন্যে যদি এতটুকু কষ্ট পাও তাহলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারবো না। যে হাত দিয়ে তুমি আমার শ্যাওলার দাগ মুছেছে তা সরিয়ে দিতে পারবো না সত্যি, কিন্তু দুনিয়ার নিয়মে আরও দুটো হাত এখন আমাকে তুলে নিতে উদগ্রীব। সে দুটোর দাবি না মানলে আমার রক্ত বিষ হয়ে যাবে যে। আর সে হাতের উপস্থিতিতে তোমার মনে তো কষ্ট হবেই। আমি আজ বুঝিয়ে গুছিয়ে কিছু বলতে পারছি না। ক্লোরোমাইটসিন বুদ্ধি লুটে নিয়েছে।
পড়তে পড়তে বীথির বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠেছিল। ঠিক যে চিঠিতে ওরা অন্তরংগ সুরে কথা কইছে, সেই একই চিঠিতে বিচ্ছেদের ইঙ্গিত।
বীথি বুঝতে পারে, বকুলের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হাশেম কেন পেল না তার মন? তারপর আরো দুটি চিঠি রয়েছে বকুলের। শেষের চিঠিগুলো পড়ে বীথির মনে হয়েছিল, বকুল ভালোবাসত হাশেমকে, কিন্তু সম্ভব হয়নি, বিচ্ছেদের জের টেনেও তাই মমতা যায়নি বকুলের। অ
সুখের চিঠিটার পরদিনের তারিখেই লেখা—-
এখন অনেকটা সুস্থ। কেমন আছো? আজ আমার গান গাইতে ইচ্ছে করছে। খুব হাওয়া দিচ্ছে কিনা। তোমার জন্যে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করেছি এ কদিন।
ছোট্ট চিঠিটা, কিন্তু বীথির সারাটা মন যেন ভরে রইলো। পরের চিঠিটায় বকুলের আবার অসুখ করেছে।
তোমার চিঠি যখন পেলাম তখন আবার আমি বিছানায়। অসুখের জন্যে কেউ এত ব্যাকুল হবে, এতে আমার চোখ সজল হয়ে ওঠে। রাগ করেছি কে বলল?
আমি কী পুণ্য করেছি যে, তুমি এমন করে আমার জন্যে প্রার্থনা করবে? তোমার প্রার্থনায় আমার প্রয়োজন আছে। আজ এই অসুস্থ শরীরে ফল কাটতে গিয়ে আঙুল কেটে ফেলেছি। মানুষের জীবনে এমন একেকটা সময় আসে যখন একটার পর একটা বিপদ আসে। তবে কতটুকুই বা আমার ভয়? আমাকে ঘিরে তুমি আছো, তোমার মতো আরো একজন আছেন।
আজ তোমার জন্যে আবার আমি প্রার্থনা করলাম। অজান্তে যে ভার তোমার আত্মায় চাপিয়ে দিয়েছি তা থেকে যেন মুক্তি পাও। তোমার জন্যে আজকে আমার কষ্ট হচ্ছে। আমাকে ঘেন্না করেও যদি বালিশের ওপর তোমার মুখ নিদ্রামগ্ন থাকতে পারে তবে সেও ভালো। তবু আমাকে বাসনা করে অন্দ্রি থেকো না। ভাবো, চলতে চলতে আমি থেমে গেছি, তবু তোমাকে যেতে হবে। এতে আমারও কষ্ট, তোমারও কষ্ট। তবু তোমাকে যেতে হবে। এমনি করে ফেলে যাওয়া অনেক ভালো।
চিঠি পড়ে চেনার বদলে আরো যেন কুয়াশা হয়ে উঠেছিল বীথির কাছে। একেকদিন রাতে হাশেম ভাইয়ের জন্যে ভীষণ কান্না পেত বীথির। বকুলকে মনে হতো রাক্ষুসী। মনে মনে অভিশাপ দিত বকুলকে। বীথির যেন সহজ বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বাস হয়ে গেছে যে, বকুলের জন্যেই ঘর ছেড়েছে হাশেম। চাচিমাকে কথাটা জিগ্যেস করতে সাহস হয়নি। আবুকে সে শুধিয়েছিল, বকুল কে, আবুভাই জানো?