.
আবু বাসায় ফিরে দেখল একটাও বাতি জ্বলেনি। কেবল রান্না ঘরের খোল৷ দুয়ার দিয়ে নিম গাছের কোল অবধি এক ফালি আলো পড়েছে। সারাবাড়িতে কেউ নেই। যেন এমন একটা পরিবেশ তার জন্যে দরকার ছিল। বিলকিসের ওখান থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে, কী করেছে, কী ভেবেছে, কিছুই মনে পড়ছে না। মাথার ভেতর যন্ত্রণাও নেই, স্বস্তিও নেই। রাজ্যের অন্ধকারে তলিয়ে থাকা বাসায় ঢুকে তার মনে হল—- হ্যাঁ, এইতো আমার বাসা। অন্ধকার বড় ভালো লাগল তার। স্নায়ুর ভেতরে উদ্বেগ ছমছম করছে, কিন্তু তবু ভালো। চাকরটার কাছে শুনল, মা বড় চাচিদের ওখানে। শুধালো, হাশেম ভাই?
ওপরে আছেন।
তখন আবু উঠে এল ওপরে। এই মুহূর্তে বড় আপন মনে হচ্ছে তার মায়ের পেটের এই ভাইটাকে।
হাশেমের ঘরে বাতি জ্বেলে দিয়ে যায়নি কেউ। ভারী রাগ হলো তার চাকরটার ওপর। ভাইয়ের নাম ধরে ডাকল একবার। কোনো উত্তব এলো না। নিমের ডালে হঠাৎ দোলন। লাগল বাতাসে, যেন ওটাই তার উত্তর। বাতি জ্বালল আবু। এতক্ষণ অন্ধকারের পর আলোটা চোখ ধাধিয়ে দিয়ে গেল। চোখ সয়ে এলে দেখল, হাশেমের বিছানা শূন্য। বারান্দাটাও তেমনি শূন্য, নিঃশব্দ।
তখন বাতি নিবিয়ে নিজের ঘরে এসে বাতি জ্বালল। দেখল, তার টেবিলের ওপর একটা চিঠি চাপা দেয়া। কাছে আসতে হলো না। দূর থেকেই লেখা দেখে বুঝল, কার চিঠি।
চলে যাচ্ছি। না এলেই পারতাম। আমি তো মরেই গিয়েছিলাম, আবার মরতে এসেছিলাম কেন? বকুলের সঙ্গে দেখা করে আজ আমার নতুন চোখ খুলেছে। দেখলাম, একজনের মৃত্যু আরেকজনের কাছে কত অর্থহীন। তাই আবার আমি বিরাট পৃথিবীর কাছে ফিরে যাচ্ছি।
তুই অন্ধ আবু। তুই অন্ধ, বীথি তোকে ডাকছে, তুই শুনছে পাচ্ছিস না? এমন করে সব অপচয় করবি?
মনের অসুখটা বীথির শরীরে গিয়ে পৌঁছেছে। আমি তো জানি, কী হবে এরপর। আমার অভিশাপই কুড়োবি, না হাত বাড়িয়ে ওকে নিবি? ও তোকে এমন করে ডাকছে আজ, তুই শুনতে পাচ্ছিস না? তুই ছিলি কোথায়? আমার ভালোবাসা রইল।
ইতি, হাশেম।
চিঠি পড়ে প্রথমে আত্মায় কোন সাড়াই জাগে না। চিঠিটাকে ভাঁজ করে রেখে দেয় শূন্য ফুলদানির ভেতরে। এ ফুলদানিটা বীথি রোজ সাজিয়ে রাখত। বাতি নিবিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল আবু।
তখন ওই জানালার ওপারে অন্ধকার থেকে, অন্ধকারের ভেতর থেকে আস্তে আস্তে ভেসে উঠল হাশেমের মুখ। আর বকুল। বকুলের মুখটা কবরের মতো মনে হলো তার। হাশেম নেই, ছিলও না কোনদিন। চলে গেছে, এটা যেন কত সুন্দর একটা শেষ। বিলকিস যা বলেছে, তাও কত মহিমা জড়ানো শেষ। বীথিকে নিয়ে গেছে, বীথি জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে—- এটাও একটা শেষ।
আমি কিছু ভাবতে পারছি না—- আরো একটি শেষ, শেষের পর। আর এই অতল অন্ধকার সব কিছু কোলে করে রেখেছে তার অপরূপ অবোধ মমতা দিয়ে। নিশ্চল হয়ে শুয়ে রইল আবু। যেন তার মৃত্যু হচ্ছে। প্রেমিক, কুটিল, মহৎ, নিষ্ঠুর মৃত্যু। যন্ত্রণাহীন মৃত্যু। মৃত্যু যে এত স্বস্তি, এত সুন্দর, তা কে জানত? স্পষ্ট করে নিজের মৃত্যুকে দেখতে পায় আবু। এত স্পষ্ট, এত মায়া জড়ানো যে মনে হয় রাজার মুকুট মাথায় দিয়ে আছে সে। আহ, দীর্ঘ হোক মৃত্যুর এই মুহূর্ত। আসুক ধীরে ধীরে, নিয়ে যাক মেঘের ভেতর দিয়ে দূরে, আরো দূরে। চোখ বুজে তাকে কোথায় কোন রাজ্যে কে নিয়ে যাবে বলে সমস্ত ইন্দ্রিয়ের দুয়ার খুলে অপেক্ষা করতে থাকে আবু। চোখ ভরে সে দেখতে পায় তার ঘর আলো হয়ে উঠেছে, যে আলো দেখা যায় না, অনুভব করতে হয়। আর এক সুদূর সুরেলা কণ্ঠ ভরে তুলেছে সারাটা পৃথিবী, পৃথিবী ছাড়িয়ে আকাশ, আর আকাশের নিচে মায়ার মতো ঘরের পর ঘর, বাঁশবন, প্রাঙ্গণ, ঐ রাস্তা। স্পষ্ট সে শুনতে পায়, ছোটবেলায় যে হাফেজের কাছে কোরান পড়ত, তিনি কবেকার রাত দুপুরের মতো অন্তরের শিখা জ্বালিয়ে আবৃত্তি করছেন পাক কোরান। তাঁকে দেখা যাচ্ছে না। অনুভব করা যাচ্ছে, তিনি তার শিয়রে এসে হাঁটু মুড়ে বসেছেন। সারাটা ঘর ভরে উঠেছে গাঢ় লোবানের ঘ্রাণে। আর তার বিছানাটা হয়ে উঠেছে। প্রাচীন, আবলুস কালো একটা খাট—- যার পা বাঘের থাবার মতো। শাদা বালিশে মাথা রেখে, শাদা চাঁদর বুক অবধি টেনে সে ডুবে আছে। আলো অন্ধকারে মৃত্যুর বাড়ানো হাত তুলে নিচ্ছে তাকে। পাশে দাঁড়িয়ে বাবা, মা, মাহবুব ভাই, হাশেম ভাই। সবাই তাকে দেখছেন, ঈর্ষা করছেন। আজ যে আমার মৃত্যু হচ্ছে। মা, তুমি ছোটবেলায় গল্প বলতে?—-মানুষ মরে গেলে তাকে শাদা ঘোড়ায় পিঠে করে আকাশ দিয়ে উড়িয়ে নিয়ে যায়?
.
আবু নিস্পন্দ হয়ে পড়ে থাকে। ঐতো বাইরে শোনা যাচ্ছে কোন অতীত থেকে ছেলেদের হুল্লোড়। ঐতো সেই পাথর বাঁধানো রাস্তাটা, যে রাস্তার দুদিকে কেবল গাছ আর গাছ গাছের চূড়া ছড়ানো নীল আকাশে যে গাছের ছায়া ধরে হেঁটে অভিমান করে অনেক দূর চলে যাওয়া যেত।
বিছানায় শুয়ে থেকে, মৃত্যুর হাতের নিচে, আবু দেখে সেই রাস্তায় রোদ পড়েছে। রোদটা তাকে সোনা হয়ে ডাকছে। ছেলেরা উতল হয়ে উঠেছে। দূরে, কতদূরে, সেই নদীটা খলখল করে তাকে ডাকছে। আবু বিছানা থেকে স্বপ্নের মতো উঠে দাঁড়ায়। সম্মোহিতের মতো বারান্দা পার হয়ে নামতে থাকে সিঁড়ি দিয়ে। বাগানের ভেতরে দাঁড়িয়ে স্পষ্ট শুনতে পায় ছেলেদের কোলাহল। রোদের ভেতরে বেড়িয়ে পড়তে ইচ্ছা করে। পা বাড়ায়। কিন্তু সামনে যে নদী। নদীর কী নাম ছিল যেন? একেক দিন বাবার হাত ধরে এই নদীটার পাড়ে ঘুম থেকে উঠে আসা ভোরের মতো আজো যেন ডাক দিচ্ছে। যোজন কুয়াশার মতো বিছিয়ে আছে তার পাড়, তার স্রোত; তার। স্পন্দন যেন বুকের স্পন্দন। বেলি গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে অন্ধের মতো আবু ব্যাকুল দুহাত বাড়িয়ে কাকে যেন খুঁজতে থাকে।