আমেনা তখন যেতে দেন নি মরিয়মকে। বলেছেন, ও এখানেই আসবে দেখিস। সত্যি সত্যি একটু আগে এখানে এসেছে হাশেম। আমেনা বললেন, তুই একটুতেই ঘাবড়াস মমো। বললাম, ছেলে যাবে কোথায়? বীথি অসুখে, দেখলি তো এখানেই এলো?
না বুবু, আমার বুকের ভেতর কেমন করছে।
আমেনা তখন মরিয়মকে মোড়া টেনে বসতে দেন। নিজেও সামনে বসেন। বলেন, আচ্ছা মমো, একটা কথা সত্যি করে বলতো।
মরিয়ম উদ্বিগ্ন হয়ে তাকান তার দিকে।
—-বীথিকে তোর বউ বলে পছন্দ হয় না? আমি বোধ হয় ওকে এ বাসায় এনে ভুলই করলাম।
কার কথা বলছ?
আহা, আবুর। তোর কী চোখ নেই, মমো? আবুর জন্যে ওর পরান পড়ে আছে দেখতে পাস না?
ওদিকে ঘরের মধ্যে হাশেম আর বীথি। বীথির আঙ্গুলগুলো তখনো তার হাতের মধ্যে। বীথিকে কী সুন্দর লাগছে তার। সে বলল, খুব কষ্ট হচ্ছে তোর? ডেকে আনবো ওকে?
বীথি মাথা নাড়ে—- না, না।
আজ হাশেমেরও অসীম কষ্ট। তাকে মাথা নাড়তে দেখে ভীষণ চটে যায়। তার হাত ফেলে দিয়ে বলে, তুই এত বোকা কেন রে? তুইও কি আমাকে শান্তিতে মরতে দিবিনে, বীথি? উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের মধ্যে অশান্ত পায়চারি করতে থাকে হাশেম। জানালাটা খুলে দেয় ভাল করে। রক্তিম আকাশ দেখা যায়। সেখান থেকে ফিরে এসে বীথির সমুখে স্থির হয়ে দাঁড়ায় সে। তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা এড়াবার জন্যে বীথি প্রশ্ন করে, অসুখ নিয়ে এলে কেন?
হাশেম আবার তার পাশে বসে পড়ে। বলে, অসুখ কইরে? আমি যে ভাল হয়ে গেছি। দ্যাখ আমার গা ছুঁয়ে। দ্যাখ তুই।
বীথির হাতটা তুলে নিজের কপালে রাখে।
—-কী দেখলি?
অসম্ভব জ্বর হাশেমের। বীথি ম্লান হাসল উত্তরে! তখন হাশেম ঝটকা মেরে তার হাতটা ফেলে দেয়। বলে, ও। তুইও বিশ্বাস করলি না?
আবার উঠে পায়চারি করতে থাকে। যেন মাঝে মাঝে কিসের টানে বাধা পড়ে যাচ্ছে, তাই বসতে হচ্ছে, নইলে এমনি করে হেঁটে হেঁটেই সে জীবনপাত করত।
ঘরের ভেতরে বাইরের রাঙ্গা আলো এসে পড়েছে। সেই অপূর্ব আলোর ভেতরে তন্ময় হয়ে চলতে চলতে ঠিক প্রথম দিনের মতো সমুখের শূন্যতাকে উদ্দেশ করে হাশেম বলতে থাকে, জানিস বীথি, পৃথিবী জুড়ে সবাই কষ্ট পাচ্ছে। মনে করলাম, বাইরে দাঁড়িয়ে সব মোহ ফেলে দিয়ে, সবার শান্তি দেখে বুক জুড়োবো। শুনতে পাচ্ছিস বীথি, আমি কী বোকা। আমার স্পর্ধা দেখেছিস তুই! —-দূর তুই কিসসু বুঝতে পারছিস না। তোর কেন অসুখ হলো রে? মরতে চাস বুঝি? বড্ড কষ্ট বীথি তুই, মরিস না।
বিছানায় উঠে বসতে চায় বীথি। মৃত্যুতে এত কষ্ট, তবে তার সান্ত্বনা কোথায়? আরো কী কষ্ট হয় মৃত্যুতে? হাশেম এগিয়ে এসে দ্রুত দুহাতে তাকে ভর দেয়, আস্তে আস্তে উঠিয়ে আনে বালিশ থেকে বিছানা থেকে। বলে, আমার সঙ্গে হাঁটবি? তাহলে আমাকে ভাল করে ধর। দ্যাখ কী সুন্দর সন্ধ্যে হচ্ছে।
বীথি তার হাত ধরে বলে, তোমার গা কাঁপছে হাশেম ভাই।
আর্তনাদের মতো শোনায় হাশেমের উত্তরটা তাই নাকি রে? বেশ, আমাকে ছেড়ে দে।
কিন্তু বীথি তবু ওর হাত ধরে রাখে। মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, তোমার আজ কী হয়েছে? নিজের অসুস্থতার কথা মনেও থাকে না বীথির। আবছা করে বুঝতে পারে এই মানুষটার মনের মধ্যে প্রচণ্ড এক ঘূর্ণি উঠেছে, যা আজ একেবারেই নতুন। চোখ বিস্ময়ে আকুল হয়ে ঠে। বীথি হাশেমের হাত ধরে নাড়া দেয়। তখন হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাশেম বলে, তোকে দেখতে এলাম, আর তুই কী না আমাকে নিয়েই পড়লি। আমি জানি না বুঝি তোর মরতে সাধ হয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে হাশেম জানালার কাছে চলে যায়।
মানুষের মনটা, জানিস বীথি, বিরাট এক বনের মতো। কুল নেই, দিক নেই, মাথার ওপরে আলো নেই—- নিথর এক বন। আর তোর বাসনা, আকাক্ষা ওটা হচ্ছে বাঘ। সোনার মতো, রক্তের মতো সেই বাঘটা সেখানে রাজা হয়ে আছে। মানুষ তাকে আফিম খাইয়ে চিড়িয়াখানায় ঘুম পাড়িয়ে রাখতে চায়। থাকবে কেন? ও যে রাজা। একদিন শিকল ছিঁড়ে অরণ্যে গিয়ে তোলপাড় করে তুলবে না?
হাশেমের চোখ কী অদ্ভুত রকমের শূন্য। ভূতগ্রস্তের মতো লাগছে তাকে। বীথির দেখে ভয় করতে থাকে। নিজের নিঃসঙ্গতা যেন আরো দশ গুণ হয়ে উঠতে চায়। হাশেম বলে চলে, হারে হা। আমি কি মিথ্যে বলছি? নইলে, সবাইকে ফাঁকি পর ফকির দিয়ে জীবনটাকে ভরিয়ে তুলতে দেখে এত খ্যাপা হয়ে গেলাম কেন?—-দ্যাখ দিকি, তোর অসুখ আর আমি বকবক করে যাচ্ছি। আয় তোর মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দি। আয়।
বীথিকে কাছে আসতে হয় না। হাশেমই এগিয়ে তার কপালে হাত রাখে। আস্তে আস্তে বুলিয়ে দেয়। বীথির যেন মনে হয়, হাশেম এমনি করে নিজেকেই সান্তনা দিচ্ছে। হাশেম বালে, ভয় পাসনে বীথি। ভয় করতে নেই। জীবন কখনো ভয়কে মেনে নেয় না। কী তুই! এত কষ্ট শুধু শুধু পাস।
হাশেম ওর কপাল ছেড়ে হাতটা তুলে নেয়। আলতো করে অপ্রত্যাশিত একটা চুমো দেয় হাতে। তারপর কিছু না বলে চলে যায়। যেন, হঠাৎ কোথাও তারপর কিছু না বলে চলে যায়। তার ছিঁড়ে গেছে। এক মুহূর্তে তাই সব স্তব্ধ হয়ে গেল। গম্ভীর হয়ে গেল বাইরের নেমে আসা সন্ধ্যের মতো। ঘর থেকে হনহন করে হাশেমকে বেরুতে দেখে আমেনা আর মরিয়ম দুজনেই অবাক হয়ে যান। হাশেম ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যায় মাতাল নৌকোর মতো। কিন্তু কী ভেবে আবার ফিরে আসে। এসে বলে, বীথিকে দেখো। আমি বাসায় যাই।