আপনাকে খুব কাছের মানুষ মনে হয় আমার। তাই শুনতে চাই।
আমি বললে আপনাকেও বলতে হবে।
আবু ইতস্তত করে একটু।
কী হলো?
বেশ বলবো।
বিলকিস হঠাৎ দেখে, আবু ম্লান হয়ে গেছে। দেখে ভয় করে তার। জিগ্যেস করে, কী ভাবছেন?
কিছু না।
বিলকিস তখন হাসল। বলল, আমাদের দুজনের অবস্থা একই রকম। বেশ তো, এত তাড়াহুড়ো কী? অন্য কোনদিন শোনা যাবে।
আচ্ছা।
আবু বুঝতে পারে না, তার ভেতরটা তবু এত অস্থির আর শূন্য লাগছে কেন! বিলকিস হঠাৎ জিগ্যেস করে, আপনার হাশেম ভাই কেমন আছেন?
চমকে উঠল আবু। মনে মনে হাশেম ভাইয়ের কথাই ভাবছিল সে, অথচ নিজেই ঠাহর করতে পারছিল না। বিলকিসের কথা শুনে কুয়াশা ছিঁড়ে গেল।
সে বলল, ভালো। ঠিকানাটা উনিই চেয়েছিলেন। আমি কিসসু বুঝতে পারছি না কেন?
ঠিক তখন ভেতর থেকে ডাক পড়ল বিলকিসের। বিলকিস যদিও আবুকে বলল, আপনি একটু বসুন; আবু উঠে দাঁড়াল।
না, থাক। অনেকক্ষণ কষ্ট দিয়েছি আপনাকে।
যাবেন? আচ্ছা।
বিলকিসের মুখ ছায়া হয়ে এলো।
আসুন। মাঝে মাঝে খবর নেবেন কেমন থাকি না থাকি।
আচ্ছা।
আবু বেরিয়ে আসে। হঠাৎ করে নিজেকে খালি খালি মনে হয়। আর যেন তার কোন কাজ নেই।
যেন তার জন্ম হয়নি, তার মৃত্যু হবে না; জীবন ছড়িয়ে আছে সারা বিশ্বে কিন্তু তাকে স্পর্শ করবে না আর।
৮. বিলকিস ভেতরে এলে
বিলকিস ভেতরে এলে তার মা বললেন, তোর আক্কেলটা কী বলতো?
বিলকিসের মনটা যেন হোঁচট খায়। নিজেকেই অবাক করে দিয়ে সে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, কেন, কী হয়েছে?
কী আবার? টুকু আর টুবলুকে নিয়ে বকুলের কাছে যাবি বলেছিলি। সেজেগুঁজে কাঁদছে। গল্পটা কমালে কী হয়?
বিলকিসের চিৎকার করতে ইচ্ছে করে। কিন্তু নিজেকে শান্ত করে বলে, তার আমি কী করব? আমি পারব না।
দুপদাপ করে নিজের ঘরে আসে বিলকিস। কোথায় যেন কী হচ্ছে। বুঝতে পারা যাচ্ছে না। এ বই সে বই ওলটাতে থাকে, চেয়ার বদলায়, জানালার পর্দাগুলো মুক্ত করে দেয় কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি নেই তার।
টুকু আর টুবলু হাত পা ছড়িয়ে কাঁদছে। মায়ের কাছে আজ তারা ফিরে যাবে বলছিল। বেরিয়ে এসে তাদের ভীষণ আদর করতে থাকে সে। তারপর কান্না থামলে নিজের ঘরে এসে চিঠি লিখতে বসে। লেখে—-
মন্টি, আজ তোমার জন্মদিন।
সকালে মনে হলো, শিয়রে দাঁড়িয়ে তুমি আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলে।
আচ্ছা, তোমার যখন ঘুম ভাঙ্গল আজ, কার কথা মনে পড়েছিল? আমার গা ছুঁয়ে বল।
মন্টি, আমার একী হয়েছে? নিজেকে আমি কিছুতেই ধরে রাখতে পারছি না। রাগ হচ্ছে, অভিমান হচ্ছে, চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। আমি ভেঙ্গে পড়বার আগেই কী তুমি আসবে? নাকি এসে আমার মৃতদেহ দেখবে? তোমার অমন করে বাইরে না থাকলেই নয়? আজ রাতটা ইচ্ছে করছে তোমাকে যেন স্বপ্নে দেখি।
চিঠিটা শেষ হলে সুন্দর করে ঠিকানা লিখল। তারপর বন্ধ করবার আগে সমস্ত কাগজে মুখ বুলে বিলকিস; যেন তার সমস্ত অনুভব, সমস্ত কথা, সম্পূর্ণ মনটা যা লেখা গেল না, এমনি করে রেখে দিল চিঠিটায়।
টুকু আর টুবলুকে নিয়ে বেরুলো সে। ওদের দিয়ে আসার পথে নিজে ডাকবাক্সে ফেলে আসবে চিঠিখানা। কিছু চিঠি থাকে, নিজের হাতে না পাঠালে মনের মধ্যে সারাক্ষণ কেমন কেমন করতে থাকে।
.
বেলা শেষে মেঘের মতো বীথি ঘুমিয়ে ছিল। হাশেম তার পাশে বসে গালে হাত রাখল। নিজের গায়েই এত জ্বর তবু বীথির উত্তাপটা ধরা পড়ছে। কাল রাত থেকে কিছু খায়নি বীথি। কদিন থেকে যে দুর্বলতা যাচ্ছিল আজ তা জ্বর হয়ে দেখা দিয়েছে।
তোকে দেখতে এসেছি রে।
বীথি শুনতে পেল না হয়ত। নাকি খুব কষ্ট হচ্ছে? তার আঙ্গুলগুলো তুলে নিল হাশেম। ডাকল, বীথি, আমি।
হাশেমের গলা কাঁপছে থরথর করে। যেন ঝড়ের মধ্যে দৌড়ে এসে একটা মানুষ আর কথা বলতে পারছে না।
নিজের ওপর নিজে শোধ নিতে নিতে ক্লান্ত অসুস্থ হয়ে গেছে বীথি। সেই ক্লান্তির ভেতর থেকে যেন মনে হলো ডাক এসেছে। তখন ফিসফিস করে স্বপ্নের ভেতরে, স্বপ্ন থেকে জাগরণের দিকে যেতে যেতে বীথি উচ্চারণ করল, আবু ভাই এসেছ!
পাশেই ছিলেন আমেনা আর মরিয়ম। এ নাম শুনে তাঁরা দুজনেই বিব্রত হয়ে গেলেন। চোখ ফিরিয়ে নিলেন বীথির দিক থেকে। এবার দুজনে দুজনের দিকে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত মরিয়ম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। হাশেম আরো শক্ত করে ধরে রাখে বীথির আঙ্গুল। চোখ মেলে তাকে দেখে সংকুচিত হয়ে যায় বীথি। এ কী করছিল সে? বুকের ভেতর মোচড় ওঠে। হাশেমের হাতটা ধরে রাখে; উৎসুক চোখে সারা ঘর অনুসন্ধান করে কার জন্যে। পরে নিভে যায়।
তখন আমেনাও বেরিয়ে আসেন। তাকে দেখে মরিয়ম বলেন, হাশেমের কী আক্কেল আছে বুবু? এত জ্বর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছে কাউকে কিছু না বলে।
মরিয়ম যেন জোর করে চিন্তা থেকে বীথিকে দূরে ঠেলে রাখতে চান। তাই হাশেমকে নিয়েই কথা বলতে থাকেন বিরতিহীন। যেন উপসর্গটা এতেই কমে যাবে। বলে চলেন, ঘরে গিয়ে দেখলাম, হাশেম নেই। মনে করলাম, আছে কোথাও। তাও এলো না। একা বাসায় আমি। আমাকে ও শুধু জ্বালাতেই এসেছে। কান্না ফুটে বেরুতে থাকে মরিয়মের কণ্ঠে। বিকেলে ছেলেকে না পেয়ে দিশাহারা হয়ে ছুটে এসেছিলেন এ বাসায়। মনে করেছিলেন, বীথির মায়ায় হাশেম বুঝি এখানে এসেছে। কিন্তু এখানেও ছিল না।