তারপর নিজের ওপরে নিজেই যেন চটে উঠল হাশেম। আধো উঠে বসে প্রায় চিৎকার করে বলল, ছাই আমি নিজেও কী বুঝতে পারছি? মনে হয় আকাশ থেকে বজ্ৰ এনে দিই সব ঠাণ্ডা করে। যাক যাক—- সাধের পৃথিবীটা চুলোয় যাক। আমার কী?
মরিয়ম ছেলের কথা একবর্ণ বুঝতে পারেন না। বলেন, ও–কী বলছিস তুই হাশেম? আমার বুকের ভেতরটা যে কেমন করছে।
তখন লাফ দিয়ে হাঁটুর ওপর উঠে বসেছে হাশেম।
আমাকে তুমি খুন করতে পারবে, মা?
শুনে মরিয়ম পাথর হয়ে গেলেন। হাশেম বলে চলল, উহ, পৃথিবীতে এত অসঙ্গতি একবার তুমি যদি জানতে পারতে, মা। একবার যদি জানতে পারতে, এক মুহূর্ত তোমার বাঁচতে ইচ্ছা করত না। গলায় দড়ি দিতে।
সে রাতেই মরিয়ম স্বামীকে বললেন, ওগো দ্যাখোনা ছেলেটার কী হয়েছে। মনে মনে মুরশেদ চৌধুরীও কম ভুগছিলেন না। প্রসঙ্গ উত্থাপনে এতদিনকার জমানো ক্ষোভে ফেটে পড়লেন।
কী আবার হবে? ঢের বাঁদর ছেলে দেখেছি আমি।
মরিয়ম কান্নাভরা গলায় বললেন, তুমি একটা নিষ্ঠুর, বুঝলে? ছেলে আমার পাগল হয়ে যাচ্ছে, তুমি বাপ হয়ে চুপ করে আছো?
পাগলই তো। নইলে অমন ব্রিলিয়ান্ট ছেলে হঠাৎ লেখাপড়া ছেড়ে দেয়, শুনেছ কখনো? পরদিন সকালে উঠে হাশেমকে পাওয়া গেল না।
.
আড়াই বছর আগে বীথির বাবা যখন মেয়েকে মেজভাই মুরশেদের কাছে রেখে গেলেন ঢাকায় কলেজে পড়বে বলে, মরিয়ম ততদিনে শোকের বরফে পাথর হয়ে গেছেন। হঠাৎ করে যেন বুড়িয়ে গেছেন তিনি। আত্মযত্নের দিকে কোনো লক্ষ্য নেই, সংসারের ভালোমন্দে চিরউদাসীন। এমন করে দিন চলে না। মুরশেদ চৌধুরী কম বোঝান নি। বড় জা আমেনা এসে কম সান্ত্বনা দেন নি। কিন্তু মরিয়মের যেন মৃত্যু হয়ে গেছে।
চাচিমাকে দেখে চমকে উঠেছিল বীথি। এর আগেও কি সে তাঁকে দেখেনি? দেখেছে। তখন কত উজ্জ্বল, মধুর হাসিতে মুখরিতা ছিলেন মরিয়ম। এখন সেই একই মানুষকে দেখে মনের মধ্যে বিষম একটা ধাক্কা পেয়েছিল বীথি। আর অন্যদিকে চাচা। সেই সদালাপী সদাহাস্য চিরউদার মানুষটিও যেন হঠাৎ করে পাথরের মধ্যে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। বড় চাচা খোরশেদ চৌধুরী নিঃসন্তান মানুষ। ঢাকাতেই থাকেন। তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, বীথি আমার কাছে থাক।
কিন্তু মরিয়মের জন্যে সেটা সম্ভব হয়নি। তিনি বলেছিলেন, না, বীথি থাকবে তার কাছে। বীথিরও মনের টান ছিল মরিয়মের জন্যে।
প্রথম দিনই কোলের কাছে বসিয়ে মরিয়ম বীথিকে বলেছিলেন, আমার কী ভাগ্য দেখ, মা। নিজের ছেলে হারিয়ে মেয়েকে কাছে পেলাম। হারে বীথি, তুইও পালাবি নাকি?
বীথির তখন কতই বা বয়স। কিন্তু বুকের ব্যথা বোঝার মতো অন্তর ততদিনে তার তৈরি হয়ে গেছে। সে বলেছে, তুমি আমাকে পর মনে করো, চাচিমা?
মরিয়ম বুঝতে পারেন কথাটা গিয়ে কোথায় লেগেছে। লজ্জিত হন। তার চিবুক নেড়ে বলেন, নারে না। আমার কথা ধরতে নেই। হাশেম চলে গেছে থেকে কী বলতে কী বলি। তুই পর হতে যাবি কেন?
বীথি বলেছে, আমি কিছু মনে করিনি, চাচিমা। আমাকে নিয়ে তুমি ভেবো না। এতদিন তোমার দেখবার কেউ ছিল না, আজ থেকে আমি হলাম।
মরিয়ম বলেছেন, বোস ভালো করে। তোর চুল আঁচড়ে দি। একেবারে জট করে ফেলেছিস পাগলি।
ঘরে হাশেমের একটা বড় ছবি বাঁধানো ছিল। বীথির মন তখন কৌতূহলী হয়ে সেই ছবিটা দেখছে। যে লোকটা তার চাচিমার এত কষ্টের কারণ ছবির মধ্যে তার মন খুঁজে মরছে সেই কারণটা। বলেছে, আচ্ছা চাচিমা, হাশেম ভাই চলে গেলেন কেন?
বড়ো সরাসরি শুধিয়ে ফেলেছিল বীথি। শুনে মরিয়ম তার মুখের দিকে পলকহীন তাকিয়ে রইলেন খানিক। পরে বললেন, কী জানিরে। বোধহয় ও আমার কোলে বনের পাখি ছিল। একদিন তাই কাঁদিয়ে যেতে এতটুকু বাধলো না।
পরে আস্তে আস্তে শুনছে বীথি—- কিছুটা আবুর কাছ থেকে, কিছুটা মাহবুব ভাইয়ের কাছ থেকে। কিন্তু তা থেকে কতটুকুইবা বোঝা যায়? আর দেয়ালে ঝোলানো ওই ছবিটা। ছবির ভেতরে যেন সাংকেতিক ভাষায় সব কিছু লেখা আছে। দুরাশায় কত কতদিন বীথি তার ছবিটাকে গভীর চোখে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে দেখেছে।
একদিন কতগুলো চিঠি খুঁজে পেয়েছিল বীথি। হাশেমের ফেলে যাওয়া বাক্সের একেবারে তলায়, এককোণে পড়ে ছিল। ভেতরটা সাজিয়ে গুছিয়ে রাখতে গিয়ে এই কাণ্ড। খামগুলোর ওপর মেয়েরি হাতে সুন্দর করে লেখা হাশেমের নাম লুকিয়ে চিঠিগুলো পড়েছিল বীথি। কাছে রাখতে সাহস হয়নি। আবার রেখে দিয়ে এসেছে নিরুদ্দিষ্ট মানুষটার বাক্সে।
হাশেমের একটা অজানা অধ্যায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল সেদিন তার কাছে। কে এই মেয়েটা যার নাম বকুল?—- যে চিঠি লিখত হাশেমকে, যার চিঠি জমিয়ে রাখত হাশেম—- যার জন্যে এত কষ্ট?
প্রথম চিঠিটা ছিল এমনি
হাশেম সাহেব,
অনেকদিন পরে যেন একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ দেখলাম। বিচার, বিশ্লেষণ, মাপা সেঁকা, অনেক হলো। অনেক বাচাল মানুষের সাক্ষাৎ মিলল। কিন্তু আপনাকে দেখে মনে হলো, আপনার অনেক কিছু থাকা সত্ত্বেও হৈচৈ করে, ঢোল বাজিয়ে তা রাষ্ট্র করতে রাজি নন। আপনি যে পরিচ্ছন্ন, নির্মল, সেজন্য ঈশ্বরের কাছে কৃতজ্ঞ। নির্মলতার পরিচ্ছন্নতার দুএকটি বিরল বিন্দুর দেখা না পেলে যে আত্মায় পচন ধরবে এতে আশ্চর্য কী! কিন্তু আমি দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, আত্মাকে আমি পচতে দেব না। আপনি মরে যান, তবু ভালো আপনার মনের সৌন্দর্য যেন না মরে এই কামনা করি। এটা দেখবেন আমার হয়ে, যারা এ পর্যন্ত সৌন্দর্যের পূজো। করেছে, মৃত ও জীবিত, তাদের হয়ে।
ইতি—- বকুল