ঠিক তখন, নটার ডাকে, আবুর চিঠি এসে হাজির। পড়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারেনি সে। এ সব কী লিখেছে লোকটা? আবার যখন পড়েছে তখন বুক কেঁপে উঠেছে। এ যে প্রার্থনা! এ যে আমন্ত্রণ।
হাশেমের ছোট ভাই আবু, এই কথাটা জানত না বিলকিস। তরশু দিন কথাটা জেনে অবধি আবুর মুখ বারবার ভেসে উঠেছিল তার চোখে। হাশেম, সেই ছেলেটা বকুল আপা যাকে ভালবেসেও কাছে করতে পারেনি। কেন পারেনি, জানতো না বিলকিস। আজ যেন মনে। হচ্ছে, তার নিজেকে দিয়ে মনে হচ্ছে, সেও পারবে না আবুকে কাছে করতে কিন্তু কেন পারবে না তা আবু কোনদিনও জানবে না।
শিউরে উঠেছিল বিলকিস।
না, তাকে স্পষ্ট হতে হবে, কঠিন হতে হবে। বকুল নিজেকে অস্পষ্টতার আড়ালে রেখে, বন্ধুত্বকে বাঁচিয়ে রেখে যে অন্যায় করেছে, আবুর বেলায় তা কিছুতেই হতে দেবে না বিলকিস।
আবুর সামনে বসে এতক্ষণ চুপ করে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। বিলকিস তাই শুধালো, কেমন আছেন, বলুন।
ভালো। আপনি?
আমিও।
এই কথাগুলো বলতে চায়নি ওরা। তবু বলতে হচ্ছে। আবু হঠাৎ মরিয়া হয়ে বলল, ভালো আছি বললে মিথ্যে বলা হয়।
কেন?
একা যে।
কেন একা থাকেন?
কেন? যদি জানতাম, কষ্ট থাকত না।
আবু খুব জেদ করে কথা বলতে শুরু করেছিল। কিন্তু তাকে নির্বাপিত হতে হল যখন। বিলকিস বলল, এ সব কথা আমি বুঝতে পারি না। যদি বুঝতে পারতাম তাহলে এমন করে সবাইকে ফিরে যেতে হতো না। তাছাড়া, আমি আর বুঝতে চাইও না।
আবুর তীব্র ইচ্ছে হলো চীৎকার করে বিলকিসকে জিজ্ঞেস করে, হাত গুটিয়ে রেখে কী আনন্দ হচ্ছে তার? কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পাবে না। বদলে বিলকিসের কথাই শুনতে থাকে। তন্ময় হয়ে বিলকিস বলছে, আমার এখন পায়ে দড়ি। যাবার পথ নেই। দেবার উপায় নেই। বিশ্বাস করুন, কেউ ইচ্ছে করে ফিরিয়ে দেয় না। আপনি এখন তরুণ, কত বড় হতে হবে। আপনাকে, আপনি কেন এমন আবর্তে পড়ে ভুগে ভুগে মরবেন?
কক্ষনো না। কথাগুলো আসলে তিরস্কার। কিন্তু সেই তিরস্কারের জন্যেই আবুর ভালোবাসা যেন আরো প্রবল হয়ে উঠলো। মনে করেছিল, বিলকিস তাকে ফিরিয়ে দিলে প্রলয়কাণ্ড হয়ে যাবে। কিন্তু কিছুই হলো না। বাইরে রোদ আছে তেমনি। জানালা দিয়ে সকৌতুকে উঁকি দিচ্ছে ডালিম গাছ নিত্যকার মতো। বিদ্যুৎ ঘুরিয়ে চলেছে পাখা। তার হাত ঘড়িটাও চলছে। যতখানি কষ্ট হবে মনে হয়েছিল, তার এক কণাও নয়; এমন কি হৃদপিণ্ডটাও এতটুকু লাফিয়ে উঠল না। যেন প্রত্যাখ্যানের কথা তার আগে থেকেই জানা ছিল।
পায়ের পাতা দিয়ে মেঝের পরে নকশা কাটতে লাগল আবু। বলল, মরব কেন? জানেন, নিজেকে আমি সব কিছুর চেয়ে বেশি ভালবাসি। আমি কেন মরব?
বিলকিস বুঝতে পারল, এতো আবুর শক্তি নয়, শক্তির মুখোশে কান্না। বলল, এ কী অলুক্ষণে কথা আপনার! যাকে ভালবেসেছেন, তাকে সাক্ষী রেখে নিজে কষ্ট পাবার কোনো মানে হয়
আবু নিজেকে নিয়ে নিষ্ঠুর হয়ে উঠেছে দেখে বিলকিস চুপ করে থাকে।
অবশেষে বলে, পাওয়াটাই কি সব? যা আপন করে দেখেছেন, তার জন্য তুচ্ছ স্বার্থটাকে বিলোতে পারলে নিজের কাছে ছোট হয়ে যাবেন যে।
হঠাৎ করে ফেটে পড়ে আবু। আর্তনাদের মতো বলে, তাহলে আমি কী করব
হুহু করে ওঠে বিলকিসের অন্তর। বকুল আর হাশেমের কথা মনে পড়ে। লুসিয়েন আর অগাস্টাস এসে সচকিত করে দেয়। পৃথিবী জুড়ে মানুষের একী বন্ধন! বকুল তো পারল না তাকে ফিরিয়ে দিয়ে সুখী হতে। ভেঙ্গে পড়েছে অগাস্টাস। আর মন্টি? মন্টি পাগলের মতো গলায় ক্ষুর দিতে চায়। ভয় দেখিয়ে লেখে, ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরবে। মন্টিকে আজ চিঠি লেখা দরকার। আবুর চোখে চোখ রেখে বিলকিস বলে, আমি জানি না। আমার অত থাকলে দুনিয়া শুষ্টু লোককে পথ বাতলে দিতাম। নিজেই পথ খুঁজে মরতাম না। যদি আপনার জন্যে মায়াই না থাকত, আজ দেখাও করতাম না।
আবু পাথর হয়ে বসে থাকে। এত সহজে সব কিছু এমন নির্ধারিত হয়ে যাবে কে জানত? বিলকিস বলল, জীবনে আঘাত পেলে কী ভাঙ্গতে আছে? আঘাতই বা কেন? যা পেলেন না তা আপনাকে শক্তি দিক, নইলে শান্তি পাবো না।
তখন বিলকিসের জন্যে মমতা হয় আবুর। না, সে কষ্ট পাবে না, দুঃখ করবে না, ভেঙ্গে পড়বে না। তাকে বড় হতে হবে। ইচ্ছে করে, কথাটা বলে।
কিন্তু সংকোচ হয়। বলতে পারে, আমাকে একটু পানি দেবেন? বড় তেষ্টা পেয়েছে। পানি আনতে গেল বিলকিস। সারাটা ঘরে সে এখন একা। সারাটা জীবন যেন তাকে একা থাকতে হবে।
পানি দিয়ে বিলকিস বলল, কী সব আমরা বকছি বলুন তো! আসুন, তার চেয়ে গল্প করি। তার কণ্ঠের সঙ্গীত কী অন্তরঙ্গ সুন্দর। আবুর মনটা এক নিমেষে পাখির মতো হালকা হয়ে গেল। সে বলল, একটা কথা, কিছু মনে করবেন না তো?
না, না।
আবু মহা উৎসাহে শুরু করল, অনেকদিন ধরে ভাবতাম আপনার কথা। আপনার গল্প বলুন না? আমি শুনবো।
বিলকিস আশ্চর্য হয়। একটু লজ্জিতও হয় যেন। বলে, আমার আবার গল্প কী?
আবু যেন বিরাট একটা আলোচনার সূত্র পেয়ে গেছে। বলে, সব মানুষেরই গল্প আছে, আপনি জানেন না বুঝি? মানুষ কত কীভাবে, কত হাজার হাজার দিন পার হয়ে আসে—- এর চেয়ে ভালো গল্প কেউ লেখে নি।
তখন বিলকিস খুব খুশি হয়ে উঠল। তার ভালো লাগল আবুর মুখোশহীন কথা বলার ঢং। বলল, আমার কথা কেন শুনতে চান?