কোনদিন বলা হয়নি বিলকিসকে। ভয়, সে যদি প্রত্যাখ্যান করে।
কিন্তু আজ, এখন, নিজেকে এত নিঃশঙ্ক আর প্রস্তুত মনে হচ্ছে। আবু উঠে দাঁড়াল। বারান্দায় তার পায়ের শব্দ পেয়ে হাশেম ডাকল, শোন।
কাছে আসতেই শুধালো, ঠিকানা পেলি?
আবু লজ্জিত হয়। আরো আগেই জানানো উচিত ছিল তার। বলে, হ্যাঁ, পেয়েছি। এখুনি দেব, না, সকালে?
সকালেই দিস।
হাশেম যেন আলস্যে চোখ বুঁজলো।
.
অনেক রাত অবধি আবু অনেকগুলো কাগজ ছিড়বার পর বিলকিসের কাছে এই চিঠিটা লিখতে পারে—
চিঠি পেয়ে অবাক হবেন না, অপ্রত্যাশিত হলেই যে তা অসঙ্গত হবে এমন কথা নেই। কোনদিন কেউ আমাকে ডাকে নি। অমন একটা ডাকের জন্যে আমি বারবার মরে জন্ম নিতে পারি, সব তুচ্ছ করতে পারি। আপনাকে আমি এমন করে লিখতে পারছি, কারণ, অলক্ষ্যে আপনি আমার আপনতম হয়ে উঠেছেন। আমার যে কী আত্মমোহ ছিল! বাঁচতে চেয়েছিলাম আমি নিজেকে নিয়েই। একেকদিন একাকীত্ব মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। তখন মনে হতো, বুকের ভেতরে কে যেন কাঁদছে। তখন অস্থির হয়ে শহরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত ঘুরে বেড়াতাম, ভিড়ের মধ্যে ডুবে গিয়ে নিজেকে ভোলাতাম—-যেন শিশুকে খেলনা দিয়ে ভোলাচ্ছি।
একদিন ঈশ্বর হাসলেন। আমার চোখের সমুখে তুলে ধরলেন একজনকে। তাকে আর ভুলতে পারলাম না। আমার মোহ ভাংগল, চূর্ণ হলো আমার অহংকার। চলমান পৃথিবী তার সমস্ত সবুজ আর রৌদ্র দিয়ে আমার দিকে কৌতুক আঙ্গুল তুলে, সমস্ত হাওয়া দূর দূরান্ত থেকে করতালি দিতে দিতে যেন বলে গেল একাকী থাকলে পারলে না।
এত কথা হলো, এতকাল ধরে ধরে এত বিনিময় করলাম, কিন্তু যে কথা বলব, তা আর বলা হলো না।
এত অনুভব করি, বলতে পারি না কেন? এত চাই, কাছে আসতে পারি না কেন?
একটা ছোট্ট ঘটনা বলি। আমার বছর বারো বয়স, তখন একদিন জোর করে ঝাঁপিয়ে পড়ে মায়ের বুকের দুধ খেয়েছিলাম। যে দুধ খেয়ে আমার ছোটভাই বেঁচে আছে তার স্বাদ কেমন জানতে চয়েছিলাম।
ভাইটি মারা গেছে।
সেদিন দুধ মুখে দিয়ে থুতু করে দৌড়ে পালিয়ে আসতে হয়েছিল। সে দুধ ছিল ক্ষীণ, নোনা আর পানসে।
জীবন কি আবার এমনি করে আমাকে তাড়িয়ে দেবে? না, আপনাকে বিব্রত করব না কোন প্রশ্ন করে। তারে একটা টংকার পড়লে সুরটা কিছুক্ষণের মধ্যে অনন্তে যায় মিলিয়ে। কিন্তু রেশ থাকে অনেকক্ষণ।
আজ সারাটা দিন আমার এমনি।
আনন্দ-পুত্র হতে চেয়েছি পৃথিবীতে। চেয়েছি, আনন্দ যেন আমার জন্ম হয়, আনন্দ যেন আমার মৃত্যু হয়। আমার যে শূন্যতা আপনার স্পর্শে আনন্দ হয়ে উঠেছে, সে শূন্যতাকে বললাম—- সার্থক তোমার প্রতীক্ষা। আর সত্তাকে বললাম—-অন্য আর কিইবা বলতে পারতাম? তুমি অনন্তকালের জন্যে সঞ্চয় করে রাখো এই আনন্দের মহিমাকে।
সেই গল্পটা মনে করুন। একটা কক্ষ ভরে দিতে হাজার টাকার কার্পেট লাগে, আবার এক পয়সার মোম জ্বালিয়েও তা ভরে দেওয়া যায়। আপনার যতটুকু পেলাম তাই আমার আলো। শূন্য হাত বাড়িয়ে রইলাম আরো অনেক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। আমার ভয় কী? আমার যে বিশ্বাস রয়েছে আপনি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না। কাল আসবো।
ইতি, আবু।
.
পারিজাত বলল, ফিরে যাবেন না। আপা আপনাকে বসতে বলেছেন।
বিলকিসদের বসবার ঘরে এসে আবু গত তরশুর সেই সোফায় বসল। ঠিক আগের মতই। দুপা ক্রস করে, দুহাত ছড়িয়ে; যেন তার অবচেতন মনে এটা একটা মায়ায় দাঁড়িয়ে গেছে। আশ্চর্য, বিলকিস কী করে জানলো বকুলকে ভালবাসত হাশেম ভাই? হাশেমের জীবনের কতটুকু জানে এই মেয়েটা? সেদিন অমন করে হঠাৎ উঠে আসতে না হলে সে জিজ্ঞেস করতে পারত। আজো জিজ্ঞেস করা যায়। কিন্তু কিন্তু আজ সকালে বিলকিস তার চিঠি পেয়েছে। এখন যেন মনে হচ্ছে চিঠিটা না লিখলেই পারত। লিখলেও, না এলে হতো। বলতে কী, আবুর বুকের মধ্যে কাঁপন উঠেছে, বিলকিস যদি তাকে ফিরিয়ে দেয়! চিঠির কথা যতক্ষণ ভুলে থাকা যায়—- ভালো। বিলকিস যতক্ষণ এ ঘরে না আসছে ভালো।
অনেকক্ষণ পরে বিলকিস এলো। মুখে তার স্নিগ্ধ হাসি। আটপৌরে শাদা শাড়ি পরনে তার, চওড়া সবুজ পাড় নেয়ে উঠেছিল। সুবাস পাওয়া যাচ্ছে। একটা স্নিগ্ধ শ্রী ঘিরে রেখেছে তার কান্তি। আবু তাকে দেখে মধুর হাসলো। যেন দুজনের মধ্যে কিছুই হয়নি।
আবু বলল, হঠাৎ এসে পড়লাম।
কেন, চিঠিতে তো জানিয়েছিলেন।
কত সহজে চিঠির উল্লেখ করতে পারল বিলকিস। বিস্মিত হলো আবু। তার আশা হলো। কিন্তু অনেকক্ষণ কিছু বলতে পারল না।
ওদিকে বিলকিসের মনটাও উদাস হয়ে উঠেছে থেকে থেকে। এ কথা তো বলা যায় না আবুকে। আজ যে মন্টির জন্মদিন। সকাল থেকে প্রস্তুত হয়েছিল যে মন, বাকবিতণ্ডা তুলে তাকে সে কিছুতেই নষ্ট করতে পারবে না।
চিঠিটা পেয়ে অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিল বিলকিস। সে জানত, একদিন না একদিন এমন একটা কাণ্ড করে বসবে আবু। কিন্তু সেটা মণ্টির জন্মদিনেই ঘটবে তা কে জানতো? ঠিক যেদিনটাতে সে একজনকে অনুভব করবে বলে জেগে উঠেছে সেই একই দিনে আরেকজনের কী ব্যাকুল আবির্ভাব। একেবারে ভোর সকালে সবার আগে ঘুম ভেঙ্গেছিল তার। গোসল করে এসে টেবিলে মাথা রেখে মন্টির জন্যে অনেকক্ষণ তন্ময় হয়ে কল্যাণ কামনা করেছে সে। ততক্ষণে ফুটে বেরিয়েছে দিনের আলো। সে আলোর বাধ ভাঙ্গা বন্যা এসে জাগিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। পৃথিবীর আর কারো কথা মনে ছিল না তার।