শুনে খোরশেদ চৌধুরী হা হা করে হেসে উঠেছিলেন।
দ্বীপান্তরেই তো! কী বলিস, বীথী? আসতে যেতে ছআনা লাগে রিকশায়, সোজা কথা? যাবার আগে মরিয়ম বীথিকে কোলের কাছে বসিয়ে অনেকক্ষণ আদর করেছিলেন। বলেছিলেন, শরীরের দিকে লক্ষ্য রাখিস, মা। বড় চাচিকে বলিস, কদিন হলো ভালো নেই তুই। তোর চাচাকেও বলে দিলাম। কাল তোকে দেখতে আসব।
তন্ময় ছবিটা থেকে মরিয়ম চমকে ফিরে এলেন বর্তমানে। যাবার সময়ে বীথির চোখে পানি ছিল, এখন তার চোখে। কোনো মতে আঁচল ঠেকিয়ে হাশেমকে বললেন, তুই এখানেই বসবি? না, ভেতরে যাবি?
এখানেই ভালো।
তাহলে বোস। আমি রান্নাঘরটা দেখে আসি।
মরিয়ম উঠে দাঁড়ালেন।
বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে বীথির খালি ঘরটা চোখে পড়ল। ভেজানো ছিল দরজাটা। বাতাসে কখন আধো খুলে গেছে। বীথি থাকতেও মাঝে মাঝে এমনি কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যেত না।
.
আবু সোজা এসে তার নিজের ঘরে ঢুকল। কামালের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় বসে যে বেপরোয়া আড়াই মেরেছে তা নয়, তার সঙ্গে প্রথম শোর ছবিও দেখেছে। অর্থাৎ মনটাকে নিয়ে ঘণ্টা পাঁচেক কৌতুক করেছে আবু। এখন আবার সেই ভাবনাগুলো ফিরে এসেছে। চোখের সামনে জীবন্ত হয়ে উঠছে বিলকিসের শাড়ির পাড়ে আঁকা ময়ূর, বাড়ি, গাছ। মনে করেছিল, ক্লান্তি অবোধ করে রাখবে মনটাকে। কিন্তু তা হলো কই? ক্লান্তি এসেছে ঠিকই, ভীষণ ক্লান্তি, কিন্তু মনটা আরো সূচীমুখ হয়ে উঠেছে। অনেকক্ষণ ভুলে থাকার পর, বাড়ি ফেরার পথে, মাথার ভেতরে নাচ শুরু হয়েছিল আবার। এখনো সেটা থামে নি।
কাপড় বদলে নিচে নামল আবু। আজ তার প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে। এমন খিদে যদি সবদিন পেত, মায়ের আর কোনো অনুযোগ থাকত না। মাকে আজ তাক লাগিয়ে দেবে আবু। বীথির দরজা বন্ধ দেখে ভাবলো, অন্ধকারে শুয়ে মেয়েটা হয়ত দুপুরের কথা ভাবছে। বড় অবিচার করা হয়েছে তার ওপর। ভাবল, ফিরে এসে ডাকবে। ডেকে বলবে, বীথি তুই আমার কথায় কিছু মনে করিস নে।
খেতে বসে দেখল, মা নেই। মা না থাকলে বীথি থাকে। মাকে গিয়ে ডাকল আবু। মরিয়ম বললেন, আমার শরীরটা ভালো নেই রে।
বলতে বলতে উঠে আসেন তিনি। আবু বলে, থাক।
বলেই সে নেমে আসে খাবার ঘরে। তন্ময় হয়ে খাচ্ছিল, মরিয়ম এসে পিছনে দাঁড়ালেন। বুঝতে পারলেন, আবু এখনো টের পায়নি। যদি জানতে পারে বীথি চলে গেছে, তাহলে কী হবে?
মায়ের মন মরিয়মের। আবু সত্যি সত্যি বীথিকে ভালবাসত কিনা জানতে ইচ্ছে করল তার। কথাটা বলে দেখলে কেমন হয়? বীথির চলে যাওয়ার সংবাদে ওর মুখ চোখ তো তাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। তার চোখে পড়বেই। আশায় তিনি সমুখে এসে দাঁড়ালেন।
প্রায় চমকে উঠেছিল আবু। মাকে দেখে রুষ্ট কণ্ঠে বলল, তোমাকে না বললাম এসো না?
তুই কি একা বসে খেতে পারবি?
আবু কোনদিন একা বসে খেতে পারে না। কেউ না কেউ থাকবে, কথা বলবে কী সঙ্গে খাবে, এই অভ্যেস। মরিয়ম হাসলেন। বললেন, তোর বড় চাচা এসেছিল।
আবু কথা বলল না। ভাবল, হাশেম ভাইকে দেখতে এসেছিল। মাথা নিচু করে খেয়ে চলল সে।
বীথিকে নিয়ে গেল।
চমকে মায়ের দিকে তাকাল আবু। দেখল, মা দুচোখ মেলে তাকে দেখছেন। অপ্রস্তুত হয়ে চোখ নামিয়ে নিল সে। কিছু একটা বলা দরকার। বলল, কখন?
বিকেলে। বীথি এখন থেকে ওঁর কাছেই থাকবে।
আবুর থমথমে মুখ দৃষ্টি এড়াল না মরিয়মের। ছেলে তক্ষুনি হাত ধুয়ে উঠে দাঁড়াল। পীড়াপীড়ি করতে ভুলে গেলেন তাকে আরো খাওয়ার জন্যে। দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি। যেন এই ছেলেটা পর হয়ে গেল তাঁর।
সিঁড়ির নিচে অন্ধকারে এক পলকের জন্যে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আবু। বীথি চলে গেছে! দুপুরের ঘটনাটি মনে পড়ল তার।
বীথি কি জানতো যে আজই তাকে নিয়ে যাওয়া হবে?
.
বিছানায় এসে শুয়ে পড়ল আবু। বীথির আজ দুপুরের চেহারা, কথা আর পথ থেকে হঠাৎ চলে যাওয়া, মনে পড়তে থাকে। চলে যাবে জানলে কাল রাতের প্রতিজ্ঞাটা কক্ষনো ভাঙ্গতে না সে। মনে মনে আবছা অনুতাপ হয় তার।
বীথি চলে গেছে বলে প্রথমে যেমন এখন আর অতটা খারাপ লাগছে না। থেকে থেকে কেবল মনে হচ্ছে, বীথি ছিল বলে একটা আশ্রয় ছিল তার।
আর কিছু না। গেছে যাক। আসলে বিলকিস আজ তাকে আচ্ছন্ন করে আছে। মাথার ভেতরে যে নাচ হচ্ছে তার উৎস বিলকিস।
উঠে এসে বারান্দা দিয়ে হাঁটতে থাকে আবু। তারপর নেবে এসে নিমগাছের নিচে। সেখান থেকে বাগানে। বাগানের সিঁড়িতে বসে ঠাণ্ডা বাতাসে প্রীত হতে থাকে আবু। মনে মনে আলোড়ন চলতে থাকে বিলকিসকে নিয়ে। নিজেকে যেন সারাদিন পর আবার সে ফিরে পাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বিলকিসকে। তার সারাটা শরীর আর আত্মা থরথর করে কাঁপতে থাকে। নিজেকে শান্ত করবার জন্যে, ঘুম পাড়াবার জন্যে, ফিসফিস করে উচ্চারণ করতে থাকে সে বিলকিসের নাম। তখন একটা অলৌকিক মায়ার মতো সৃষ্টি হয় তার চারদিকে। বিলকিস হয়তো এখন ঘুমিয়ে পড়েছে। না, ঘুমিয়ে পড়বে কেন? তার পরীক্ষা; হয়ত রাত জেগে, বাম হাতে কপালের ভার নামিয়ে লেখাপড়া করছে। আলোর আভায় গড়ে উঠেছে। তার মুখ ঘরের অন্ধকারের ভেতর থেকে। সব ঘুমিয়ে পড়েছে মানুষ, দালান, বাড়ি, রাস্তা, দেয়ালের ওপরে থাবা বিছিয়ে শুয়ে থাকা বেড়ালটা। বিলকিসের শরীর থেকে কুয়াশার মতো এক দীপ্তি আর কোন স্মরণাতীত কাল থেকে উথিত চেনা অগুরুর ঘ্রাণ যেন তার। ইন্দ্রিয়ের দুয়ারে এসে আঘাত করছে।