বীথিকে আজ বিকেলে খোরশেদ চৌধুরী এসে নিয়ে গেলেন। মেয়েটা কাঁদে নি, কোন কথা বলে নি। মরিয়ম যেন অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারছিলেন, বীথির হৃদয়টা ছিঁড়ে যাচ্ছে।
কদিন থেকে ওকে নিয়ে যাবার কথা হচ্ছিল। মরিয়ম নিজে পারেন নি মেয়েটাকে বলতে। মুরশেদ চৌধুরী বলেছিলেন।
কথাটা শোনার পর থেকে বীথিকে লক্ষ্য করেছেন তিনি। আশ্চর্য হয়েছেন ওর সহ্য করবার ক্ষমতা দেখে। অতটুকু শরীরে এত বড় ব্যথাকে কবর দেয়ার শক্তি ও পেলো কোথায়? বীথি যে চলে যাচ্ছে, তাকে চলে যেতে হচ্ছে, এটাই যে তার শেষ যাওয়া এ বাড়ি থেকে এইটে তিনি ভুলতে পারছিলেন না। তবু যদি মেয়েটা ভালোয় ভালোয় যেত তাহলে মরিয়ম কাঁদতে পারতেন—- চলে যাওয়ার শোকটাকে মুক্তি দিতে পারতেন। কিন্তু যে অপবাদ তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল তা মনে করে কাঁদতে সাহস পান না তিনি। বদলে কান্নাকে অনুমতি দিয়েছেন তাঁর অন্তরকে খাক করে দেওয়ার জন্য।
বিরাট নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে অশান্ত পাতাগুলোর মতো মরিয়মের ভেতরটা হুহু করে ওঠে। বীথিকে নিয়ে যে তিনি কতখানি ভরে ছিলেন, আজ চলে যাবার পর তা ভীষণ রকমে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নামাজ পড়ে ওপাশের বারান্দায় গেলেন মরিয়ম। সেখানে হাশেম একটা ইজিচেয়ারে চোখ বুজে পড়ে আছে। সন্ধ্যের একটু আগে ওকে শোয়া থেকে উঠিয়ে এনে বাইরে বসিয়ে দিয়েছেন। নইলে আল্লাহর লানৎ পড়বে।
এসে তার কপালে হাত রাখলেন মরিয়ম। জ্বরটা কমেছে একটু। এত ডাক্তার দেখালেন, ওষুধ আনালেন, কিন্তু তবু ছেলেটা ভালো হচ্ছে না দেখে মন তাঁর এমনিতেই খারাপ হয়ে। আছে। আজ পাঁচ বছর পর হারানো ছেলে কি ফিরে এসেছে মায়ের কোলে মরবার জন্যে?
সময়টা ভর সন্ধ্যে। মরিয়ম বুকে থুতু দিলেন, দরুদ পড়লেন। সন্ধ্যে বেলায় এমন অলুক্ষণে কথা মনে আনতে নেই। আল্লাহ তুমি মাফ কর।
হাশেমের পাশে মেঝেয় বসে ছেলের হাত ঘসে দিতে লাগলেন মরিয়ম। যেন তার করতল থেকে মৃত্যুর বিরুদ্ধে শক্তির ফৌজ পাঠিয়ে দিচ্ছেন ওর আত্মায়। হাশেম চোখ মেলে। তাকাতেই মরিয়মের বুকটা ভেঙ্গে পড়ল। এই ছেলেটা কত ছোট ছিল একদিন। তাঁর কোল ভরে চাঁদের মত শুয়ে থাকত। ইচ্ছে করলে, হাশেমকে যেন এখনো তিনি কোলে করতে পারবেন।
বললেন, ঘরে যাবি, বাবা?
হাশেম হাসল। কথা বলল না। কিন্তু ওতেই বোঝা গেল, ঘরে যাবে না। মরিয়ম চুপ করে। তাকিয়ে থাকেন। হাশেম তবু এ কদিন বকাবকি করত, যা খুশি তাই বলত। আজ সকাল থেকে একেবারেই চুপচাপ। আশঙ্কা হয় তার। হাশেম যে কথা বলছে না, এটা অশুভ চিহ্ন বলে মনে হয়। মনে হয়, হাশেম এখুনি উঠে পায়চারি করে বেড়াক, এলোপাথারি কথায় কান ঝালাপালা করে দিক—- তিনি স্বস্তি পাবেন। তিনি তবু অনুভব করতে পারবেন হাশেম বেঁচে আছে, হাশেম ভালো আছে।
মরিয়মের আকুতিটা যেন গিয়ে পৌঁছুলো হাশেমের অন্তরে। হাশেম বলে উঠল, তোমার ভয় করছে, মা?
কেনরে?
আমি মরে যাবো বলে।
বালাই ষাট, সোনা আমার।
মেয়েটাকে তাড়িয়ে দিয়ে তুমিও কম কষ্ট পাচ্ছ না।
মরিয়ম অবাক হয়ে ছেলের দিকে তাকান। যেন ছেলের কাছে করুণ একটা অপরাধ করে ধরা পড়ে গেছেন তিনি। বললে, কষ্ট কী? পরের মেয়ে, চিরদিন থাকবে বলে তো আসেনি। চিরদিন থাকবে বলে তো কেউ আসে না। তবু কষ্ট হয়। কষ্ট না হলে তুমি আজ অমন করছ কেন?
মরিয়ম কিছু বলেন না। হাশেমের কাছে ধরা পড়েও যেন ভাল লাগছে।
হাশেম বলল, নিমগাছটার দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, মা। পাখিগুলো ঘরে ফিরে এসেছে। সারাদিন কোথায় ছিল ওরা? আকাশে বাতাসে মাঠে ঘাঠে সারাটা পৃথিবী ভরে উড়ে বেরিয়েছে। তারপর রাতের আশ্রয় যেখানে, যেখান থেকে ভোরবেলায় বেরিয়েছিল, সেখানে ফিরে এসেছে সবাই। আমার কী মনে হয় জানো মা? এই ছবিটাকে যদি সহজ করে মানুষ বুঝত, তাহলে কোনো দুঃখই থাকত না। সহজ বলেই তো বুঝতে পারাটা এত কঠিন। প্রাণের টান যেখানে, সে যেখানেই যাক না ফিরে আসবে। আমি তো বলি, মানুষ মিথ্যেই কষ্ট পায়। আমরা বাইরের পাওয়া, বাইরের চেহারাটাকে এত দাম দিয়েছি যে অন্তরকে একেবারে পায়ে ঠেলে বসে আছি। কেউ বুঝলো না বলেই তো খ্যাপা লাগে আমার।
মরিয়ম শুনতে শুনতে ওর কপালে হাত রাখেন। মনে একটু আশার সঞ্চার হয়। হাশেম আবার বকতে শুরু করেছে, যেন স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। তিনি আদর করে বলেন, সবাই বুঝবে কী? সবাই তোর মতো পণ্ডিত হলে বুঝত।
পাণ্ডিত্যের কী আছে, মা? ঐখানেই তো আরেকটা মস্তফাঁকি। পাণ্ডিত্য দিয়ে তর্ক করা যায়, ভয় দেখানো যায়; বোঝানো যায় না, ভালোবাসা যায় না। অন্তরকে বুঝতে হলে অন্তর দিয়ে। বুঝতে হয়।
কথা শেষ করে মায়ের করতলের নিচে পড়ে থাকে হাশেম।
৭. আবু সেই যে দুপুরে
আবু সেই যে দুপুরে এক পলক এসেই বেরিয়ে গেছে, এখনো ফেরেনি। হাশেম ছিল বিছানায় শুয়ে। যাবার আগে বলে যেতে এসে বীথি তাকে ঘুমন্ত দেখেছিল। ইতস্তত করে ফিরে যাচ্ছিল। তখন হাশেম বলে উঠেছে, শোন। মনে করেছিলাম চোখ বুজে তোকে ফাঁকি দেব। কই, পারলাম না।
বীথি কাছে আসেনি। ঘরের মাঝখানেই অধোমুখে দাঁড়িয়েছিল। তাকে ওরকম দেখে হাশেম বলেছে, যা তুই। জেলখানায় না দ্বীপান্তরে যাচ্ছিস যে বিদায় নিতে হবে তোর। আসিস একবার, কেমন?