বীথির তখন কী হয়, তাকে অনুসরণ করতে থাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো।
.
বীথি আর আবুকে দেখা যায় হাইকোর্টের পাশ দিয়ে মগবাজারের দিকে হাঁটতে। রোদে তেতে উঠেছে ফুটপাথ। লম্বা রাস্তাটা সুম সুম করছে উত্তাপে। একটা গাছের ছায়ায় পানির কল। পানি জমেছে এক চিলতে। সেখান থেকে তৃষ্ণা মেটাচ্ছে চকিত একটা কাক। আবু বলতে থাকে, আমাকে তোর কী মনে হয়, বীথি?
বীথি কী জবাব দেবে বুঝতে পারে না। মনে মনে তোলপাড় করতে থাকে, এ প্রশ্নটাও কি তাকেই করা? বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়। উত্তর করে, আমার কী মনে হয়, জেনে কী করবে?
কী জানি কী করবো। কিন্তু জানতে ইচ্ছে করে যে। জানিস বীথি, আমার মাথার মধ্যে কিস্সু ঢুকছে না। খালি মনে হচ্ছে, আমার বুঝবার শোনবার সব শক্তি চলে যাচ্ছে। যে জিনিসটা একেবারে সামনে, তাকেও যেন কেউ দেখিয়ে না দিলে দেখতে পারব না—- এমনি অন্ধ হয়ে যাচ্ছি। আমার এ কী হলো, বীথি?
তাড়াতাড়ি বীথি বলে, রোদে হাঁটতে বলেছে কে তোমাকে?
কে আবার? কি করবো তাহলে?
অসুখ করবে যে।
তার কি বাকি আছে রে?
বীথি ছায়া ঘেঁষে ঘেঁষে চলে। তার সঙ্গ নেয়ার জন্যে আবুকেও ছায়ার ভেতর দিয়ে চলতে হয়। আবু বলে, তোর ওপরে ভারী অবিচার করলাম।
বীথির বুকটা স্তব্ধ হয়ে যায়।
কদিন থেকে শরীর খারাপ তোর, তোকে এই রোদে বার করে আনলাম। মরে যাস যদি?
বীথির তখন মমতা হয়। উত্তর করে, আমার কিছু হয়নি তো। তোমার কথা বলছিলাম। তুমি একটা অসুখ বাঁধিয়ে বসবে এই আমার ভয়। যাচ্ছ কোথায়?
আবু তার দিকে তাকিয়ে আনমনে হাসে। বলে, হঠাৎ আজ আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি কী অসম্ভব রক্ত রঙ ফুল ধরেছে। তখন বুঝলি বীথি, আমার মাথার ভেতরে সেই আগুন জ্বলে উঠল। থমকে দাঁড়ালাম। তোর হাসি পাচ্ছে? তোকে ডাকতে হলো। তুই না এলে কী করতাম?
আবু আস্তে আস্তে নিজের অস্তিত্ব আর সঙ্গতি ফিরে পাচ্ছে দেখে বীথি একটু আশ্বস্ত হলো।
যে উন্মত্ততা একটু আগে বাসায় দেখেছিল এখন তা পড়ে এসেছে। বীথি বুঝতে পারে, আবুর একটা ধাক্কা লেগেছে কোথাও। যেন হাশেম ভাইয়ের কথা বলার আভাস ফুটে বেরুচ্ছে তার কণ্ঠ থেকে। কেবল সেই ধাক্কাটা ভালো না মন্দের দিকে এইটে বীথি বুঝতে পারছে না। দাঁড়াও, আবু ভাই।
কেন রে?
বীথি যেন সব বুঝতে পারছে। বীথি চোখ মেলে দেখতে থাকে ফুলে ফুনে আকাশের নীলের ভেতরে লাল একটা রাজপথ। যেন আস্তে আস্তে ওদের দুজনকে চারদিক থেকে এইসব আগুন ফুলগুলো জড়িয়ে ধরছে। ডুবিয়ে দিচ্ছে আশেপাশের সব কিছু।
আর আবু ভাবতে থাকে, বিলকিস এখন কী করছে? সে অনুভব করতে পারে বিলকিসের আত্মা তার খুব কাছে কোথাও দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাকে নিরিখ করছে। আবু উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
বীথি মুখ ফিরিয়ে বলে, যাই।
যাবি? কেন? না যেতে পারবি না।
কোন জবাব না দিয়ে বীথি একা একা হাঁটতে থাকে। আবু যখন বারবার তাকে ফেরাবার চেষ্টা করে তখন কঠিন হয়ে বলে, কাল রাতে কথা দিয়েছিলে না?
দিয়েছিলাম। তাহলে এলি কেন?
আবু কিছুতেই ছেড়ে দেবে না তাকে।
শোন, বীথি।
রাস্তায় একটা সিন না করলেই না, আবু ভাই?
তিরস্কারটা শুনে ফেটে পড়ে আবু।
আমি না হয় তোকে জ্বালাই, তাই বলে সিন করতে পারব ভাবতে পারলি? যা, যেখানে খুশি যা। তুই মরে যেতে পারলি না?
যাবোই তো, মরেই যাবো।
বীথি একটা খালি রিকশা পেয়ে উঠে বসলো। বলল, এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবে নাকি?
আবু কোনো জবাব না দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে যায়।
.
রাস্তার মোড়ে কামালের সঙ্গে দেখা। আবুকে দেখে সে রিকশা থামায়, জিগ্যেস করে, ক্লাশ শেষ হলো বুঝি?
উত্তর দিতে ইচ্ছে করছে না। কোন রকমে বলল, হ্যাঁ।
তাহলে আয় আমার সঙ্গে। মেলা খবর আছে।
বীথি চলে যাবার পর আবার আবুর মাথার মধ্যে প্রপাতের মতো ফিরে এসেছিল বিলকিস। বিলকিসের ওখানে যে কথাগুলো হয়েছিল সব একাকার হয়ে একটা সিম্ফনির মতো বাজছিল। বিলকিসের সমুখে এসে নিজের অক্ষমতা, নিজের বোবা হয়ে যাওয়ার প্রবৃত্তিকে শাপ শাপান্ত করছিল সে। বিলকিসের কাছে আবার যেতে ইচ্ছে করছে। এখন গেলে কেমন হয়? না। দুপুরে দুবার দেখা হলে কী ভাববে বিলকিস? এ–কী টানাপোড়েন! যার কাছে নিজেকে উন্মুক্ত করে দেয়ার আকাঙ্ক্ষা, সংকোচ তার কাছেই? নিজেকে খুন করে ফেলতে পারলে যেন শান্তি পাওয়া যেত। আবু হঠাৎ নিজেকে চোখ বুজে ছুঁড়ে মারে কামালের দিকে। বলে, চল, কোথাও বসি। সেদিন খাওয়াতে চেয়েছিলি, আজ হোক।
রিকশায় উঠে বসে আবু শুধালো, কী খবর বল? মেলা খবর শুনে মনে হচ্ছে ভাগ্যটা হঠাৎ ফিরিয়ে ফেলেছিস তুই?
কামাল সুখী আত্মবিলাসী হাসি হাসল। তার হাসিটা অন্যসময়ে আবুর কাছে ভালগার মনে হতে পারত। কিন্তু এখন চোখেই পড়ল না। হাসির তোড় থামিয়ে কামাল বলল, হঠাৎ দুটো লাইসেন্স পেয়েছি। সেদিন বলছিলাম না খুব লস হচ্ছে?
আবু কামালের কথার ভেতরে নিজেকে ডুবিয়ে রাখবার চেষ্টা করে। যেন কামালের ব্যবসার ওঠা পড়ার সঙ্গে তার এবং সারা পৃথিবীর উত্থান পতন নির্ভর করছে।
.
মাগরেবের নামাজ পড়তে গিয়ে আজ কেমন খালি খালি লাগে মরিয়মের। মনে হয়, কী যেন নেই তার সংসারে। কী যেন ছিল, হঠাৎ করে পালিয়ে গেছে। নামাজ পড়ে মুনাজাত করতে গিয়ে নিজের হাতের ভেতরে, সন্ধ্যার করুণ অন্ধকারের ভেতরে বীথির মুখ দেখতে পান মরিয়ম।