এলেন, বসলেন না। বলছিলেন গল্প করবেন।
আবু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে মুখ অন্য দিকে রেখে উচ্চারণ করে, কাল, না হয় পরশু আবার আসব।
তার কথা বলার ধরনটা অদ্ভুত লাগে বিলকিসের কাছে। হঠাৎ মনে পড়ে বকুলের ঠিকানার কথা। বলে, বকুলের ঠিকানাটা নিয়ে যান।
পেয়েছেন? কী করে?
জবাব না দিয়ে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে ঠিকানাটা লিখে দেয় বিলকিস। লিখতে লিখতে বলে, বকুলকে ভালোবাসত আপনার হাশেম ভাই, না?
শুনে অবাক হয় সে। বিলকিস কী করে টের পেল? বকুল তাকে বলেছে? অসম্ভব, সে বলতেই পারে না। কিছুতেই যেন আবু ভাবতে পারে না, বকুল উচ্চারণ করবে এই অতীত। বিস্মিত আবু ঠিকানাটা হাত বাড়িয়ে নেয়। বিলকিস দরোজার পর্দা ঠেলে ধরে বলে, আসবেন কিন্তু।
আবু কোনো উত্তর না দিয়ে পথে নেবে আসে। সমস্ত শক্তি যেন তার অন্তর্হিত হয়ে গেছে। তার চেতনা আচ্ছন্ন করে সঙ্গীতের মতো ফিরে ফিরে বাজতে থাকে আসবেন কিন্তু আসবেন কিন্তু।
বিলকিস যেটা তাকে বলতে গিয়ে বলতে পারে নি বকুল তার বড় বোন।
.
আগুন পথের দুধারে ফুলে ফুলে জ্বলছে একেকটা গাছের চূড়ায়। চোখ ধাধিয়ে দেয়। চোখ রাখা যায় না। প্রকৃতি যেন আজ ষড়যন্ত্র করে আবুর সঙ্গে চতুরালি করছে। কোনদিন যা চোখে পড়ল না, বিলকিসের বাসা থেকে বেরিয়েই দুচোখের দুয়ার ঠেলে তা ভেঙে পড়ছে। চলতে চলতে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সে গাছের অজস্র শিখরের দিকে। কোথায় যেন মিলের আভাস।
তার মনটাও এখন এমনি অস্থির অথচ উদাস; এমনি মাতাল করা, লাফিয়ে পড়া, অথচ দূর। পথ দিয়ে চলছে, তবু মনে হচ্ছে এখনো বিলকিসের সমুখে বসে আছে। এখনো যেন স্পষ্ট তাকে দেখতে পাচ্ছে ঐ প্রখর উজ্জ্বল বর্ণের ভেতরে।
বিলকিসকে আজো কিছু বলা হলো না। মনের ভেতরে চাপা একটা আক্রোশ ফুসতে থাকে। কী হতো বললে? হয়ত যা হতো, তা স্বর্গের চেয়েও সুন্দর। হয়ত, বিলকিস অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত। পরে আবছা গলায় উচ্চারণ করত, আমি জানতাম।
আবুর দুচোখ পুড়ে যেতে থাকে রক্তিম ফুলে।
অস্থির হয়ে বাম করতলে ডান হাত মুঠো করে সে আঘাত করতে থাকে। খুব হাঁটতে ইচ্ছে করছে। রোদে তেতে জ্বর জ্বর হতে ইচ্ছে করছে। তীক্ষ্ণ, দুর্বোধ্য, মানে হয় না উচ্চারণে মুখটা ব্যথা করে ফেলতে ইচ্ছে করছে, ঠিক যেমন ছোটবেলায় একেকদিন করত। অকারণে তখন হঠাৎ খেপে গিয়ে ধুলো পানি ঝড়ে একাকার হয়ে যাওয়া যেত। কিন্তু সেই অনেক আগের দিনগুলোয় ছিল না বেদনার স্মৃতি। আর আজ কোথায় যেন বেদনার বীজ অংকুরিত হয়ে উঠবার জন্যে থরথর করে কাঁপছে।
এ আমার কী হলো? এ আমার কী হলো?
আবু মনে মনে বুক–ভাঙ্গা–মন্ত্রের মতো আওড়াতে থাকে। আবার চোখ মেলে ওপরের দিকে, সামনে ডানে বামে তাকায়। গাছ আর গাছ।
রঙের উৎসব লেগেছে ডালে ডালে।
.
যেন সে জানত বীথি বসে বসে বই পড়ছে এই ঝিমঝিম দুপুর বেলায়। তক্ষুনি বাসায় ফিরে সোজা বীথির ঘরে এলো।
বীথি সত্যি সত্যি বই পড়ছিল। সে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে দাঁড়াল আবুর রোদে পোড়া লাল চেহারা দেখে। কোথায় ছিল? কী করছিল? বীথি বুঝতে পারল না, আসবে না বলে মাত্র কালরাতেই প্রতিজ্ঞা করবার পর আজ এমন কী অসাধারণ কারণ ঘটলো যে আসতে হলো?
যে কোনো কারণই থাক, জোর করে পাথর হতে চেষ্টা করল বীথি। সে সব শুনেছে, সব টের পেয়েছে। তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে এ বাসা থেকে বড় চাচার বাসায় নিয়ে যাবার জন্যে। যাবে না সে, কিছুতেই যাবে না।
আবু বলল, বীথি আছিস?
যেন খুব নিশ্চিন্ত হলো তাকে ঘরে পেয়ে। হাত বাড়িয়ে বলল, আয়, আমার সঙ্গে।
আশ্চর্য হলো বীথি। প্রতিজ্ঞার কথা মানুষ মাত্র ষোল ঘণ্টার ব্যবধানে ভুলে যায় কী করে? আবু আবার বলল, আয় না।
আস্তে আস্তে চেযারে গিয়ে আগের মতো বসলো বীথি। বইটাকে আঁকড়ে ধরল শক্ত হাতে। বুঝতে পারল আবুর সেই আবেগ উদ্দাম মুহূর্তগুলো আবার ফিরে এসেছে। সেই উদ্দামতার তাড়নায় কোন কিছুই আর টিকতে পারছে না।
আবু একটা চিত্রের মতো হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার আকুল হয়ে উঠেছে। ঠোঁটের পরে অনুপম সি আঁকা। হাসিটা যেন বলতে চায়, ভয় কী? হাসিটা যেন পৃথিবীর সমস্ত অশুভের বিরুদ্ধে জয়ের প্রতীক চিহ্ন। বীথি বই ওলটাতে ওলটাতে জোর করে উচ্চারণ। করল, না, না।
মাথা নাড়তে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে। আরেকটু হলেই অশ্রু গড়িয়ে পড়ত। চোখ একেবারে ভরে উঠেছে। মুছতে পারছে না, পাছে আবু দেখে ফেলে। নিজেকে সে জোর করে মগ্ন রাখতে চেষ্টা করে বইয়ের পাতায়। আবু তখন পেছনে এসে দুহাত দিয়ে বীথির দুকাধ শক্ত করে ধরে। মুখ নাবিয়ে বলে, রাগ করেছিস? সেদিন আমার চিঠিটা পেয়ে সত্যি সত্যি রাগ করলি?
বীথি বিস্মিত হয়ে যায়। চিঠিটার কথা বুঝতে পারে না। আবু তাকে তো কোনো চিঠি লেখে নি। বীথি বলে, কোন চিঠি?
আবু যেন শুনতেই পায়নি। যেন বলাটাই তার একমাত্র কাজ। আবু কণ্ঠে মমতা তুলে বলে চলে, আমার চিঠিতে তুই ঝাজটুকুই দেখলি, আমাকে দেখলি না? বেশ তো, যদি চাস আমি আসব না। তাহলে আসব না।
আবু তো বীথির মধ্যে বীথিকে দেখছে না। বীথি তখন আবুর চোখের দিকে তাকায়। ভয় করতে থাকে।
তোমার কী হয়েছে, আবু ভাই?
আমার? কিছু না তো।
আবু মনে মনে বুঝতে পারে, যার উদ্দেশে এই বলা সে বীথি নয়, কিন্তু তবু বীথিকেই তার বলতে হচ্ছে। এতে উপশম হচ্ছে, মনের ভেতরে মুক্তির স্রোতোধারা বয়ে যাচ্ছে। আবু তাকে দুপায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দেয়। বলে, চল, বীথি।