ভেতর থেকে একটু পরে পারিজাতের হাতে এলো নেবুর এক গেলাশ ঠাণ্ডা শরবৎ। পারিজাত তাকে দেখে হাসল এবং গেলাশ নামিয়ে রেখেই দৌড়ে পালাল।
বড় রোদ, একেবারে আসমান শুদ্ধ তেতে উঠেছে, শরবতের গেলাশ হাতে নিয়ে ভাবলো আবু। সেটা ঠোঁটে ঠেকিয়েছে কী ঠেকায় নি, বিলকিস পর্দা ঠেলে এসে বসলো। মাথায় তার আধ ঘোমটা কাপড় তুলে দেয়া।
অপরূপ লাগল।
রোদ্দুরটা এড়াতে গিয়ে ও ঘর থেকে আসবার সময় হয়ত মাথায় কাপড় তুলে দিয়েছিল, এখনো নামিয়ে নেয়া হয়নি।
বাসায় এসে বিলকিস তার পরনের শাড়িটা বদলে নিয়েছে। এখন যেটা পরে তার সমুখে বসে আছে ঠিক তেমনটি যেন কতকাল আগে মা পরতেন, ভাবল আবু। পাড়ের মধ্যে নীল সুতোয় আঁকা ময়ুর, বাড়ি, গাছ, তারপর আবার ময়ুর বাড়ি, গাছ—- পর পর আবার ময়ুর, বাড়ি, গাছ। তার পায়ের পাতা ঘিরে কোলের ওপর দিয়ে, বুক জড়িয়ে মাথার পরে গিয়ে পৌঁছেছে ময়ুর, বাড়ি, গাছ।
তন্ময় হয়ে দেখছিল আবু। মায়ের ট্রাঙ্ক খোলন্যাপথলিনের ঘুম পাড়ানো ঘ্রাণটা যেন ফিরে আসছে।
বিলকিস কোনরকম ভূমিকা না করে সোজা বলল, সেদিন কি আপনার মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল?
তার ছোট্ট চিঠিটার কথা বিলকিস আজো ভুলতে পারেনি। বিলকিস বলল, এমন করে চিঠি লিখে গেলেন, যে কেউ দেখলে একটা কিছু ভেবে বসত। কেন লিখতে গেলেন ও সব? আমি তো কারো সঙ্গে রেখে ঢেকে মিশিনি।
শেষ কথাটার সঙ্গতি খুঁজে পেল না আবু। একটুপর উত্তর করল, কী জানি কেন লিখলাম। দেখুন না, আপনার থাকবার কথা ছিল, থাকলেন না, আগে থেকে নোটিশও দিলেন না। অনেক দূর বয়ে এসেছিলেন, না পেয়ে রাগ হবারই কথা।
খুব বোদ্ধা মানুষের মতো ভান করে আবু; নিজেকেই নির্মমভাবে বিশ্লেষণ করতে থাকে সে। বলে চলে ক্ষমাহীন কণ্ঠে, মনটা বুঝতে চাইল না। কেন চাইল না? কী জানি। ছেলে মানুষের মতো রাগ করে বসল। নইলে সত্যি তো কী করে সম্ভব হল? অন্যায় হয়েছে। থাক, খুব হয়েছে।
বিলকিস তাকে বাঁ হাতের করতল তুলে বাধা দেয়। বিলকিস যেন আবছা আবছা বুঝতে পারে আবু তার মনের একটা গোলমাল ঢাকতে গিয়ে অযথা নিজের প্রতি রুঢ় হচ্ছে। বিলকিসের যেন মন হয় তার চোখের ভেতরে দুর্বোধ্য কী একটা লিপি পড়তে পারছে। উল্টা দিকে আবু ভেতরে আচমকা পরম একটা আলস্য অনুভব করতে থাকে। সব কিছু নিরর্থক মনে হয়। খামোকা বলে, আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করতে চেয়েছিলাম একদিন।
আমি তো ভালো গল্প বলতে জানি না।
বেশ তো, আমি না হয় বলবো, আপনি শুনবেন।
শোনার অভিনয় করতে পারবো হয়ত। তাতে খুশি হবেন?
নিষ্ঠুর শোনায় কথাটা। আবু একটা কথাও বলতে পারে না। যেন এক ফুঁ এ কেউ বাতি নিবিয়ে দিয়েছে। চোখের সমুখে মিছিল করে চলতে শুরু করেছে ময়ুর বাড়ি গাছ, আবার ময়ুর বাড়ি গাছ, আবুর চোখ এসে তার রক্তিম পা ঘিরে পাড়ের ওপর স্থির হয়।
বিলকিসও বুঝতে পারে এমন করে কথাটা বলা ঠিক হয় নি। কিন্তু না বলেও তো উপায় ছিল না। মিছেমিছি লোকটা ভুগবে। সহজ করে দেয়ার জন্য বিলকিস জিগ্যেস করল, সেদিন কে এসেছিলেন?
কোথায়?
আপনাদের বাসায়।
আমার বড় ভাই।
বাইরে ছিলেন বুঝি?
আবুর মাথায় ভেতরে হঠাৎ বাঘের মতো একটা উজ্জ্বল দীপ্তি লাফ দিয়ে পড়ে। ঝুঁকে পড়ে সে বলে, হাশেম ভাই বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলেন।
পালিয়ে?
বিবাগী হয়ে।
সে আবার কী?
আবু যেন খুব তুষ্ট হতে পারছিল না বিলকিসের মুখে পালিয়ে শব্দটা শুনে। নিজের ওপরেও রাগ হলো, কেন সে শব্দটা ব্যবহার করতে গিয়েছিল! হাশেমকে যেন সে ভীষণ ছোট করে ফেলেছে। অনুতাপ হতে লাগল তার। বলল, একজনকে ভালবাসতেন হাশেম ভাই।
কী হলো তার?
সে ভালবাসত না।
বিলকিসের কাছে কথাটা বলতে গিয়ে কেমন হাস্যকর শোনাচ্ছে আবুর নিজের কানেই। এ কী হচ্ছে বুঝতে না পেরে সে বিব্রত বোধ করতে থাকে। অপেক্ষা করতে থাকে কখন বিলকিস সত্যি সত্যি হেসে ফেলবে, সে মনে মনে চটে যাবে কিন্তু কিছু বলতে পারবে না। কিন্তু আশ্চর্য, বিলকিস হাসল না। বরং তার গভীরতম দেশে গিয়ে বাসা করে নিল আবুর কথাকটি। ছায়া হয়ে এল তার সারাটা মুখ। বলল, জানেন, মানুষের ভেতরটাকে এত আমি চিনেছি যে, আপনার ভাইয়ের ব্যথাটা যেন বুঝতে পারলাম।
আবুর তখন তীব্র ইচ্ছে করে নিজের আত্মার ওপর থেকে একটানে সমস্ত আবরণ ফেলে দিতে। মাথার ভেতরে এক অশান্ত নাচ হতে থাকে। মানুষের ক্ষমতা এত বাধা কেন? তার মনের পৃথিবীকে কেন শুধু কথার ভেতর দিয়ে, কাজের ভেতর দিয়ে প্রকাশ করতে হবে? জানান না দিলে কেন কেউ বুঝতে পারবে না তার ভেতরে কী হচ্ছে? এ শক্তি কেন মানুষ পেল না যে, সরাসরি আত্মা থেকে আত্মায় ছড়িয়ে পড়বে সমস্ত তরংগ?
একী? আপনি বড্ড ঘামছেন।
আবুর চমক ভাঙ্গে।
পাখাটা বাড়িয়ে দেব?
দিন।
পাখা হঠাৎ দুরন্ত গতি পেল। তার বাতাসে যেন ঝড় উঠল বিলকিসের শাড়িতে, চুলে। পাখার কেন্দ্র থেকে সরে আসতেই আবার শান্ত হয়ে গেল সব। বিলকিসকে হঠাৎ রক্তের মধ্যে আপন করে অনুভব করে আবু। মনে হয়, তার মাথার ভেতর থেকে একটা শক্তি ফেটে ঝাঁপিয়ে পড়ে ভাসিয়ে দেবে সব কিছু। মুখে বলে, আমাকে উঠতে হবে।
যাবেন?
আবুর সত্যি সত্যি যেতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু বসে থাকাও অসম্ভব। জোর করে সে বলে, হা। দরকার আছে।