হঠাৎ হাশেম বলে, বীথি, আমার আবার জ্বর আসছে নাকি দ্যাখতো?
উদ্বিগ্ন হয়ে সে হাশেমের হাত ধরে জ্বরটা বুঝতে চেষ্টা করে। বলে, কই না তো।
আসছে রে আসছে। আমি বুঝতে পারছি না? আজ আবার আমার খুব বকাবকি করতে ইচ্ছে করছে।
থাক, তোমাকে বকতে হবে না। ঘরে চলো।
হাশেমের সে কথা যেন কানেই যায় না। বলে, জীবনে বেঁচে থাকার দিন সৃষ্টি কর, বীথি। নইলে মানুষ হয়ে, অনুভূতির মত সাংঘাতিক সব বোমা বুকে নিয়ে জন্মালি কেন? দুজনে বাসায় ফিরে আসে। হাশেমের জ্বর সত্যি আবার এসেছে।
.
বীথি, বীথি, শোন।
বাতাসের মতো অতিদূর, কোমল, প্রায় ফিসফিস কণ্ঠ কাঁপন তোলে। রাত এখন অনেক। বীথির বড় আশা হয়, এই বুঝি সে আবার বেঁচে উঠল ভ্রম হয়, যেমন করে দল মেলে পদ্ম তেমনি করে কোথাও উন্মোচিত হচ্ছে তার জীবন। বীথি বাইরে এসে দেখে আবু তার জন্যে নতমুখে অপেক্ষা করছে। অন্যদিন হলে সে নিজেকে তার ডাকের মুখে পাথর করে রেখে বিছানায় পড়ে কাতরাতে; আজ যেন তার সম্মোহন লেগেছে।
তোর সঙ্গে কথা আছে, বীথি। বাগানে আসবি একবার?
বাগানে সেই পুরনো সিঁড়ির ধাপে বসলো বীথি আর আবু।
ঠাণ্ডা হাওয়ার জন্যে বীথি তার শাড়ির আঁচল ভালো করে গায়ে জড়িয়ে বেলি গাছটার দিকে তাকিয়ে রইল। সেদিন তার কী ভূতে পেয়েছিল, গাছটার অমন সর্বনাশ করে রেখেছে। আজ অবধি একটা নতুন কলিও আসে নি। তবুও কোথা থেকে কিসের সৌরভ ফুটে বেরিয়েছে। তুই আমাকে জ্বালাতেই এসেছিস, বীথি?
বীথি অবাক হয়ে যায়। অবাক হয়ে আবার চোখ নামিয়ে নেয়। তার প্রস্তুত মন যেন আর্তনাদ করে খানখান হয়ে ভেঙে যায়। বেঁচে উঠবার বাসনা ছিল বীথির। আজ যদি আবু বলত, তাহলে সে সব দিতে পারত।
আবু তাকে চুপ দেখে বলে, জ্বালানো নয়তো কী? আমি নাকি তোকে বিয়ে করবার জন্যে খেপে উঠেছি। শুনেছিস?
বীথির তখন উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু শরীরের কী হয়েছে, যেন এইখানে তার জন্ম, এইখানে মৃত্যু।
আবার আবু বলে, কিরে, সবাই বলছে, তোর কানে যায় না?
বীথি কী উত্তর দেবে? অভিমান হয় প্রচণ্ড। বুকটা ফুলতে থাকে কবুতরের মতো। আবু তো ঠাস্ করে তাকে একথা বলতেই পারে। আবুর কি? তার কাছে সে তো কেবল অনুভূতি ঢালবার গেলাশ ছাড়া আর কিছুই নয়। নইলে কোনদিন কী বীথির দিকে সে তাকিয়ে দেখেছে? এইতো এখনো যে আবু তার সম্মুখে আছে, যেন সে আদৌ এখানে নেই।
কিরে, কথা বলছিস না।
বীথি তখন উত্তর করে, আমি শুনিনি।
শুনে আবু তরংগের মতো ধ্বনি সৃষ্টি করে তার হাসিতে। বলে, সবাই কী একচোখো, বীথি। তোর সঙ্গে যে আমার ভালবাসা নেই, আমি তাকে যে একটুও ভালোবাসি না, এইটে কারো চোখে পড়ল না। চোখে পড়ল কখন তোর কাছে আসি, কখন তুই বেরোস আমার সঙ্গে, এইসব।
বীথি শিউরে উঠে। আবু তার চারধারে এমন এক কঠিন বৃত্ত টেনে আত্মমগ্ন হয়ে আছে যে। দেয়ালের ওপারে তাকাবার চোখ তার অন্ধ এখন।
শরীরের সমস্ত শক্তি একত্র করে বীথি উচ্চারণ করল, কেন তুমি আমাকে টানো? আর টেনো না। আমি এসব কিছু বুঝি না। তোমার হাতে কি আমাকে মরতে বলো।
এতগুলো কথা একসঙ্গে কোনদিন বীথি বলেছে বলে আবুর মনে পড়ে না। অবাক হয়ে শুধোয়, তোর আজ কী হয়েছে?
কী হবে? কিছু না।
তারপর একটু থেমে যোগ করে, এ কথা বলবার জন্যে আমাকে এভাবে ডেকে না আনলেও হতো।
আবু হাসে।
কেন? কেউ দেখলে গুজবটা বিশ্বাস করবে। এই ভয়, না? একে তুই ভয় করিস?
ভয় করবো কেন? আমি তোমাকে ভালোবাসিনি। ভয় কিসের?
এই কথাটা বলতে গিয়ে তার যে কী কষ্ট হলো তা আবু জানতেও পারল না। বীথির সমস্ত স্নায়ু যেন টানটান হয়ে যোচড় খেতে লাগল। বীথি কাঠ হয়ে বসে রইল।
আবু নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বীথি, তুই আর আমার কাছে আসিস না, আমিও আসবো না। সাধ করে ক্ষতি ডেকে এনে লাভ কী?
বীথি ভাবে, এই যদি তার মৃত্যুর মুহূর্ত হয়, তাহলে পেছনে একটি মাত্র দিন শুধু রইল। আর কিছু না। একটা দিন কি একজন মানুষের অহংকারের জন্যে যথেষ্ট? মরতে তার ভয় করতে লাগল, যেন এখুনি সত্যি সত্যি তার মরণ আসছে।
অশান্ত উঠে দাঁড়ায় আবু।
তবু তো তুই আমাকে বুঝতে পারতি। আজ থেকে সে পথটাও বন্ধ করে দিলাম রে। মরতে হয়, আমি নিজের ভেতরেই মরে যাব।
চমকে ওঠে বীথি। আবুও যে মৃত্যুর কথা ভাবছে।
হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে আবু বলে, জানিস বীথি, আমি একটা পাথরকে ভালবেসেছি।
বলতে বলতে আবু যেন স্পষ্ট দেখতে পায় বিলকিসকে।
আমার ভাগ্যটা এমন কেন রে? কী দেখলাম আমি ওর? যেদিন প্রথম দেখলাম সেদিন মনে হলো, আমার জন্মের মুহূর্ত থেকে ও আমার এইখানটায় বাসা করে ছিল।
আবু হাত দিয়ে নিজের হৃদয় দেখায়। দেখিয়ে বিসদৃশ রকমে চুপ করে থাকে। এক সময়ে জেগে উঠে বলে, কোনদিন ভালবাসলে বুঝবি, এই অক্ষমতার বরফে পা রেখে দাঁড়িয়ে থাকাটা কী।
বলে আবু ফিরে যা বারান্দা দিয়ে। বারান্দা দিয়ে সিঁড়িতে, সিঁড়ি দিয়ে ওপর তলায় তার নিজের ঘরে। আবু যদি ফিরে আসত তাহলে দেখত, বীথির মাথার ভেতরে আবার সেই অবোধ্য যন্ত্রণা হচ্ছে, বীথি নিঃশব্দে কাঁপছে হাঁটুর ওপর মুখ নামিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে।
৬. পাখাটা ছেড়ে দিয়ে বিলকিস বলল
পাখাটা ছেড়ে দিয়ে বিলকিস বলল, বসুন। আমি এখুনি আসছি।
রোদ্দুরে রোদ্দুরে বেশ তো হেঁটে বেড়ানো চলছিল আবুর, বিলকিস তাকে গাড়ি থামিয়ে তুলে নিয়ে এসেছে বাসায়। সেদিন সে তাকাতে পারেনি বলে আজ কি মোলআনায় শোধ দেবার ইচ্ছে?