কম্পিত কণ্ঠে বীথি বলে, না, কই?
পরে বলে, একটু একটু পারি।
হাশেম তখন আবার হাসে। বীথির কাঁধে হাত রেখে সন্ধ্যের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলে, বীথি, এ হচ্ছে একটা বন্ধন। তোর মানব–জন্মের মাশুল। দ্যাখ, আমি ধর্ম মানিনে, আমি কেবল একটা জিনিসেরই দাম দিই—-যাকে আলোকিত আত্মা বলি।
বীথি শুধোয়, বুঝতে পারলাম না কিন্তু।
হাশেম তখন বিশদ করে বলতে চেষ্টা করে, ভাল থেকে মন্দটা চিনে নেবার ক্ষমতা অর্জন। করা চাই, বীথি। এর কথাই বলছি, মানুষের জন্ম থেকে ঐ একটিই সাধনা। আর সব তো তার কাজ নয়, কাজের নামে ফাঁকি। বলেছি, ধর্ম মানিনে, তাহলে আমার বিশ্বাস কিসে? বিশ্বাস আমার তোর সবার অন্তরের পরে, বীথি। মনটাকে প্রথমে শিক্ষিত করে তুলতে হয়। একবার শিক্ষা শেষ হলে তার আর ভয় নেই। তখন মনের নির্দেশে সে যা কিছু করতে পারে, যা করবে সব ভাল।
বীথি বলে, দেশ শুদ্ধ মানুষকে কি এই বুঝিয়ে এলে, যে ওপরে কেউ নেই?
তা কেন? ঈশ্বর আছেন, নিশ্চয়ই আছেন। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে এতকাল যা শুনেছিস, সব মিথ্যে। তিনি আমার অপরাধের জন্যে দোজখে নেবেন না, পুণ্যের জন্যে বেহেশতের ডবল মালা গলায় পরিয়ে দেবেন না। আমরা সবাই তাঁর স্বর্গের আনন্দের অংশ। কিন্তু মানুষ তো? তাই পৃথিবীতে স্বর্গ সৃষ্টি করতে গিয়ে কেউ যদি অনাসৃষ্টি করে বসি তো তিনি ব্যথিত হন, শাস্তি দেন না, দিতে পারেনই না। সেইজন্যে তো বলি, বিশ্বাসকে বড় করে তোল। কী করে?
হাশেম এক মুহূর্তের জন্যে দাঁড়াল।
সবার মতো তুইও প্রশ্নটা করলি। ওইখানেই সবাই ভুল করে আমার কাছে হাত পেতে দাঁড়ায়। আমি নিজেই যে ভুগছি এইটে কেউ বুঝলো না, সাধু মনে করে সবাই পা জাড়িয়ে ধরলো। পাঁচটা বছর আমি স্থির থাকতে পারিনি রে।
বীথি মনে মনে হাশেমের কথাগুলো নিয়ে ভীষণ ভাবতে থাকে।
ভালোবাসতে শেখ, বীথি। খুব বড় করে ভালোবাসা। মানুষের সবচেয়ে বিচ্ছিরি, কিন্তু সবচেয়ে সুন্দর বৃত্তি ওইটে। যে স্বর্গে যাবার জন্যে মানুষের মাথা কুটে মরা, সেতো এই ভালোবাসারই রূপসৃষ্টি। এর পেছনে পরিকল্পনাটা দেখেছিস ঈশ্বরের? মানুষকে তিনি হাড় মাংসের ভেতরে এমন একা করে রেখেছেন যে, তাকে বেরুবার জন্যে সাধনা করতেই হবে। আত্মার এই বেরিয়ে আসা, এর নামই তো ভালোবাসা। কিন্তু এত যে বলছি, বোঝাতে পারব না তবু। নিজের রক্ত দিয়ে বুঝতে হয়।
বীথির কেমন ভয় করতে থাকে হাশেমের কথা শুনে। হাশেম কথা বলতে বলতে তাকে পেছনে ফেলে আপনমনেই হাঁটছে। নিজের মধ্যে আবার ডুবে গেছে লোকটা। বীথির দিকে যেন তার দৃষ্টিই নেই।
বীথি জোরে পা ফেলে তার সঙ্গ নিলে, হাশেম মুখ ফিরিয়ে বলে, ইস্, জীবনে এত অসংগতি, বীথি। মাহবুব এসেছিল না? ওর কথাই ধর। ইতিহাসে এম,এ, পড়ে ফার্স্ট ক্লাস পেল। কিন্তু কাজ নিল কী? কেরানির। যার সঙ্গে ইতিহাস জানার কোনো সম্পর্কই নেই। এখন আবার। দাঁড়িয়েছে প্যারেডের মাঠে। একটার সঙ্গে আরেকটার এত গরমিল যে দিনভোর হো হো করে হাসলেও তোর হাসি ফুরোবে না। তবু কি মাহবুব বুঝতে পারে? আসলে যে কাজ ওর। করার কথা তা হয়ত এ তিনটের একটাও না। অথচ বেশ আছে।
মাহবুবকে হঠাৎ নতুন আলোয় দেখতে পায় বীথি। বলে, হয়ত তাই।
হাশেম বলে, একী শুধু তার একার? সবার। মানুষের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে, সে নিজের সাফাই চমৎকার সৃষ্টি করতে পারে। বড় বিচ্ছিরি ক্ষমতা। তাই আসলে যেখানে মানুষ মরে আছে, সেখানে সে ভাবে বেঁচে আছে। বেঁচে কজন থাকতে পারে, বীথি?
প্রশ্নটা করে নিজেই তার উত্তর ভাবতে থাকে হাশেম। পরে বলে, এত যে বকে চলেছি, রাস্তার মানুষ শুনলে মনে করবে, আমি পাগল। মনে করবে, পৃথিবীতে যুদ্ধ, খাদ্য বলে কোনো সমস্যাই নেই। তা কেন? বরং বাইরে থেকে এগুলোই তো প্রবল। কিন্তু ভেতরে? মানুষের আত্মার ভেতরে এত অরাজকতা, শূন্যতা চলছে যে তার একটা বিহিত না করলে। কী হবে ভেবে দেখেছিস? ভেতরের ফাঁকিটা ভরাবার জন্যে মানুষ নিজের সঙ্গে কেবলি ফাঁকি খেলছে এইটে বুঝতে পারিস না?
বীথির মনে হয়, হাশেম ভাই বেঁচে আছে।
হঠাৎ হাশেম তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, মানুষের আয়ু কত, বীথি?
বীথি ভাবতে ভাবতে উত্তর দেয়, চল্লিশ—- পঞ্চাশ ষাঠ আনকের আরো বেশি।
হাশেম বলল, এটা হচ্ছে মানুষের আরেকটা ফাঁকি। ধৃষ্টতাও বলতে পারিস।
শুনে বীথি অবাক চোখে তাকায়।
হাশেমের চোখে যেন মেঘের মতো ছায়া লেগেছে। সে বলে, মানুষের আয়ু আসলে একদিন দুদিন তিনদিন, বড়জোর চার দিন। কোনো মানুষের আয়ু আবার একেবারেই নেই। মরবার। সময় মানুষ এক মুহূর্তে পেছনের যে কটা দিনের কথা মনে করতে পারে, যে কটা দিনের জন্যে তার আবার জীবন শুরু করতে ইচ্ছে করে, সেই কটা দিনই তার আসল আয়ু। জীবনে এ রকম দিন দুটো তিনটের বেশি আসে না, বীথি।
বীথি তখন নিজের কথা ভাবতে থাকে। চোখ বুজে মনে করতে চেষ্টা করে, সে বেঁচে ছিল কটা দিন? অবাক হয়ে যায়, যখন তার চোখে ভেসে ওঠে সেই রাতটার কথা যে রাতে আবু তাকে নিয়ে বাগানে অশ্রান্ত গায়চারি করছিল আর বলছিল, তোকে কেন ডাকলাম, বীথি?
বীথি বিব্রত হয়ে পড়ে। আর তো সে মনে করতে পারছে না। তাহলে এই কি সে পরম দিন যেদিন তার জীবন ছিল সত্য, পৃথিবী ছিল আনন্দ?