আবু খেতে বসলে আমেনাও তার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলেন। দেখলেন আবুর গোগ্রাসে খাওয়া। একটু মন্দা পরলে শুধোলেন, কী সব শুনি, আবু?
আবু চোখ তুলে তাকাল। বুঝতে পারল না।
কী?
বলতে গিয়ে অপ্রতিভ হয়ে পড়লেন আমেনা। বড় জোর বলতে পারলেন, ঐ আর কী!
আবু এবারে অবাক হয়ে গেল। বড় চাচিমার কথায় সম্পূর্ণ একটা নতুন সুর বাজছে।
গ্লাসে পানি ভরে দিতে দিতে তিনি বললেন, হ্যাঁরে, তুই নাকি বীথিকে বিয়ে করবি?
কাকে?
আহা, বীথি। শুনছি, তাই জিজ্ঞেস করলাম।
আবু আমেনার দিকে একটুখন তাকিয়ে থেকে হাত ধুতে ধুতে বলল, ঠাট্টা করছ কিনা বুঝতে পারলাম না।
ওই তোর খাওয়া হলো?
তোয়ালে দিয়ে হাত মুছে আবু তার চেয়ার আমেনার মুখোমুখি নিয়ে বসল। বলল, হয়েছে। তুমি ঠাট্টা করছ বলে খাওয়া নিয়ে আমিও ঠাট্টা করব নাকি? আমার বেশ খিদে পেয়েছিল।
আমেনা রাগ করলেন শুনে।
তোর সাথে ঠাট্টা করবার আর কথা পেলাম না?
আবু হঠাৎ গম্ভীর হয়ে গেল। বুঝতে পারল। বলল, তোমাদের সব হয়েছে কী? সেদিন সন্ধ্যায় মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ৰাথি কোথায়? আমাকে অবাক করে দিয়ে উত্তর দিলেন—-
ওকে নিয়ে এত মাতামাতি কেন? মাতামাতি কিসের, চাচিমা? কেন, বীথির আমি কী করেছি?
তবে কি ওরা এমনি বলে?
কে কী বলে না বলে তা আমি জানব কী করে?
বীথির সঙ্গে বেড়াতে যাস না তুই?
যাই।
ওর ঘরে যাস?
যাই।
যাবার একটা সময় আছে।
বীথির কাছে আমার আবার সময় বুঝে যেতে হবে নাকি?
কথাটার অন্য মানে বুঝলেন আমেনা। বললেন, তবে যে বললি ওর সঙ্গে ভাব নেই!
বেশ তো বীথিকেই জিজ্ঞেস করে দেখো। ওর সঙ্গে কী আমার আর কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না?
এটা একটা সম্পর্কের ছিরি হলো, আবু?
রাগ করে উঠে দাঁড়ায় আবু।
চললি?
যাবো নাতো কী!
.
দুপুর থেকে জ্বরটা নেই হাশেমের। মাথায় বালতি বালতি পানি ঢালার পর এই এতক্ষণে চোখের লালটা কমেছে। মরিয়ম ছেলের মাথা মুছিয়ে দিয়ে তোয়ালে নিঙড়ে রাখলেন।
হাশেম শুধাল, বীথি কই, মা?
এইতো এতক্ষণ ছিল তোর কাছেই, লক্ষ করিসনি। ওর শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না, ঘরে গেছে।
হাশেম উদ্বিগ্ন হলো।
কেন, কী হয়েছে?
কিছু না।
মরিয়মের বাঁ হাতে রয়েছে হাশেমের মুখ। তিনি সিথি করিয়ে দিচ্ছেন আস্তে আস্তে। মরিয়মের মন বীথি চলে যাবে শুনে অবধি খারাপ হয়ে আছে। তার ওপরে সে রাতে বীথির জড়িয়ে ধরে অমন কান্না তাঁকে আরো দুর্বল করে দিয়ে গেছে যেন। নিয়ে যাওয়ার কথা। শুনলে বীথি কষ্ট পাবে, এটা তার চেয়ে আর কেউ ভালো জানে না।
মায়ের হাত থেকে সরে এসে হাশেম বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজতে খুঁজতে বলে, ওকে একা থাকতে দিও না, মা। একা থাকলে ও মরে যাবে। তুমি ওর দিকে তাকিয়ে দেখতে পারো না?
দেখিরে দেখি।
জানো মা, ওই তোমাদের অসুবিধে। মানুষের অন্তরটা হচ্ছে একটা আলাদা পৃথিবী। মানুষটার নিজস্ব পৃথিবী। তোমারই পেটে ধরা ছেলে, অথচ তার বুকের ভেতরে কী আছে। জানতে পারো? কেউ কি কারো কথা জানতে পারে? বার থেকে আবছা আবছা শুধু অনুভব করা যায়। বীথিকে জানবে কী করে? সেদিন প্রথম দেখলাম। দেখে যেন আমার নিজেরই ভয় করল।
দরোজায় দাঁড়িয়ে বীথি।
মরিয়ম বললেন, তুই আবার উঠে এলি?
হাশেম চোখ মেলে দেখে। হাত বাড়িয়ে দেয়।
আয়, বীথি। জ্বরটা তুই কমিয়েই দিলি।
মরিয়ম খুশি হয়ে ওঠেন।
এখন ভালো লাগছে, বাবা?
হ্যাঁ।
বলে হাশেম স্নান হাসে। আবার সেই সুন্দর হাসিটা।
বীথি তখন তার শিয়রে বসে কপালে হাত রাখে। হাশেম বলে, এলি কেন? মা বলছিলেন তোর শরীর খারাপ। তুইও মরবি নাকি, বীথি?
.
সন্ধ্যের আগে দিয়ে হাশেমকে হাঁটতে দেখে সবাই অবাক হলো। এই দুপুরেও দাঁড়াতে পারছিল না। মরিয়ম ব্যস্ত হয়ে উঠলেন।
উঠলি কেন, হাশেম?
হাশেমের যেন তা কানেই যায় না। লম্বা লম্বা পা ফেলে কেমন অদ্ভুতভাবে হাঁটতে থাকে বারান্দা দিয়ে।
মরিয়ম তখন একেবারে তার কাছ বরাবর উঠে আসেন। তিরস্কার করে বলেন, তুই আমাকে জ্বালাতেই এলি, হাশেম। পড়ে গিয়ে মাথা ফাটাবি নাকি?
হাশেম মায়ের কাঁধে হাত রেখে বলে, বড়ড ভীতু তুমি। বলেছি না, শরীরটা এতকাল চোখ বুজে থেকে এখন শোধ নিচ্ছে। শরীরটা যা খুশি করছে, আমি তাই বলে বসে থাকব নাকি? আমাকে হাঁটতে দাও, মা।
মরিয়ম তখন ঘরে এসে বীথিকে পাঠিয়ে দেন তার সঙ্গে থাকবার জন্যে।
হাশেম ততক্ষণে নেমে গেছে রাস্তায়।
রাস্তাটা বিকেলের আভায় শান্ত হয়ে আছে। দুধারের বাসাগুলো আড়াল পড়েছে সুন্দর করে ছাটা দেয়াল–গাছে। বাঁধানো নিকানো চত্বরের মতো ভ্রম সৃষ্টি করছে রাস্তায় পীচ।
বীথিকে দেখে হাশেম বলল, মা পাঠিয়ে দিলেন বুঝি? বেশ তো আয়, দুজনে মিলে বেড়ানো যাক।
হাশেম বীথিকে পেয়ে আশ্বস্ত হলো। এই মুহূর্তে কথা বলার একটি লোক দরকার। মাথার মধ্যে কথারা তখন থেকে জোট পাকাচ্ছে।
অনেকক্ষণ চুপচাপ হাঁটবার পর বীথি হঠাৎ শুধোয়, তুমি অমন করো কেন, হাশেম ভাই?
হাশেম মুখ উজ্জ্বল করে হাসে।
কী করি রে?
বীথি এই কটা দিনে হাশেমকে নিজের এত কাছে মনে করতে পেরেছে যে, সেই কথা জিগ্যেস করতে আর কোন বাধা নেই। বকুলের কথা ভাবতে থাকে বীথি। মুখে বলে, আর কেউ হলে বিছানা থেকে উঠতে পারত না।
আচমকা উত্তর আসে হাশেমের কাছে থেকে, তুই নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারিস না?