বীথি দেখছিল মরিয়মকে। পাঁচ বছর পর নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া ছেলেকে ফিরে পেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছেন তিনি। বোবা চোখ দিয়ে অসহায়ের মতো ছেলেকে অনুসরণ করে চলছেন। যাবার সময় লক্ষণ দেখা দিয়েছিল, তবে কি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছে হাশেম? হাশেম কথা বলতে বলতে চলতে চলতে কখন বীথির সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল সেটা টের পেয়ে বীথি চঞ্চল হয়ে উঠল। তার হাত থেকে গেলাশ নিয়ে সবটা পানি ঢকঢক করে খেয়ে শুধাল, এই মেয়েটি কে মা?
ছেলের হাত থেকে শূন্য গেলাশ ফিরিয়ে নিয়ে মরিয়ম বললেন, বীথি—- তোর ছোট চাচার বড় মেয়ে। তুই যাবার পর এখানে এসেছে।
তাই হবে। অনেক ছোট দেখেছিলাম।
বলতে বলতে হাশেম আবার গিয়ে বসল সোফায়। তার মুখ থেকে নিজের কথা শুনে বীথির কেমন সংকোচ হলো। চলে যাবার উদ্যোগ করল চাচিমার হাত থেকে গেলাশ নিয়ে, তখন পেছন থেকে ডাকল হাশেম।
এই শোনো।
বজ্রের মতো কণ্ঠস্বর বীথির পা জোড়া অবশ করে দিয়ে গেল যেন।
শোনো এদিকে।
মন্ত্রমুগ্ধের মতো বীথি এসে দাঁড়াল তার সমুখে। হাশেম হাত বাড়িয়ে তার সুদীর্ঘ বাম বাহু দিয়ে স্পর্শ করল ওর কাঁধ। সঞ্চারিত করল শক্তি। আস্তে আস্তে সে মেয়েটাকে বসিয়ে দিল মেঝের ওপর, পায়ের কাছে। বীথি অবাক চোখে তাকিয়ে রইল তার দিকে।
এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখে বিচলিত বোধ করলেন মরিয়ম। এগিয়ে এসে বললেন, কেন, বীথিকে চিনতে পারছিস না তুই?
আমি ওর চোখ দেখছি, মা। আমি ওর চোখ দেখছি। আমি ওর চোখ দেখছি।
মন্ত্রের মতো বিড়বিড় করে বলতে থাকে হাশেম। তারপর হঠাৎ কাঁধ থেকে হাত টেনে নিয়ে আচমকা বলে, এত কষ্ট পাস কেন, বীথি?
কী ছিলো তার কণ্ঠে, কথা শুনে বীথির চোখ সজল হয়ে উঠতে চাইলো। কিছু বলতে পারল না। তখন জোর করে মাথা নাড়ল। মাথা নাড়তে গিয়ে সারা গা কেঁপে উঠল থরথর করে, যেন তার সব আবরণ খসে খসে পড়ছে।
ভীত হলেন মরিয়ম। বললেন, ওকে ঘাবড়ে দিয়ে আনন্দ হচ্ছে তোর?
তার ছেলে যে সত্যি পাগল হয়ে গেছে, এইটে মনে করে কান্না পেল তাঁর।
বীথির দিকে চোখ রেখেই হাশেম মাকে বলল, ঘাবড়ে দেব কেন মা? যা সত্যি তাকে কবর দিয়ে রাখলে বিশ্রী একটা অসুখ হয়। সে অসুখ থেকে মুক্তি মৃত্যুর পরেও আসে না, জানো না তুমি? কিরে বীথি, কী হয়েছে? কষ্ট পাস কেন?
বীথি মৃদুকণ্ঠে বলতে চায়, কই, নাতো।
কিন্তু শোনা যায় না।
হাশেম পা দুটোকে আবার গুটিয়ে আনে বুকের কাছে। চেপে ধরে নিবিড় করে দুহাতের বেষ্টনীতে। এই কবছরে এই মুদ্রাদোষটা দাঁড়িয়ে গেছে ওর। বলে, মানব জন্মের দোষই ওই, বুঝলি? শুধু কষ্ট পাবে। বুঝতে পারবে, অথচ কিছু করতে পারবে না। শোন, ভাল মন্দ বুঝতে পারিস? কোনটা আলো আর কোনটা অন্ধকার? নাহ, তোকে অনেক শেখাতে হবে, নইলে বেঁচে থাকবি কী করে? বেঁচে থাকার জন্যে বই পড়, এঞ্জিন বানানো, দালান গড়াই যদি যথেষ্ট হতো তাহলে মানুষ কাঁদতেই জানত না। ভালোই হলো, এখানে এসে আমাকে আর বসে থাকতে হবে না। তোকে নিয়ে একটা কাজ পাওয়া গেল। যাঃ পালা শীগগীর।
বীথি উঠে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তে কে যেন তাকে ভীষণ রকমে দুর্বল করে দিয়ে গেছে। হাশেম বলল, হ্যাঁ শোন, আমাকে একটা কম্বল দিতে পারিস? জ্বরটা খুব জেঁকে আসছে রে।
.
তিন ছেলে মরিয়ম আর মুরশেদ চৌধুরীর। একেবারে ছোট আবু, এবার এম এ পাট টু–তে পড়ছে। মেজ মাহবুব, চাকুরি করে, বিয়ে করে বউ নিয়ে থাকে গেণ্ডারিয়ায়। আর সবার বড় হাশেম পাঁচ বছর আগে এম এ পড়তে পড়তে পরীক্ষা দিল না।
তখন জিজ্ঞেস করলে খুব একটা অন্যমনস্ক গলায় উত্তর করত, পড়ে কী হবে? পড়ে কিছু হয়?
এটা উত্তর হলো না; কিন্তু এর চেয়ে বেশি কিছু বলত না হাশেম। বাবা শাসন করলেন, মা কাঁদলেন, বড় চাচা এসে বোঝালেন একদিন। কিসসু হলো না তাতে।
তখন ভীষণ চুপচাপ থাকত হাশেম। সারাটা দিন বসে বসে কী ভাবত তার হদিস কেউ পেতো না। একেকদিন দেখা যেত বারান্দায় পায়চারি করতে করতে দরাজ গলায় কবিতা আবৃত্তি করছে। কিংবা বাগানে একটা গাছ পছন্দ হয়ে গেছে, তার গোড়ায় পানি ঢালার অত্যাচারে সেটা যদ্দিন না মরছে, যেন নিস্তার নেই। মরে গেলে মুখ দিয়ে শুধু একটা অস্ফুট ধ্বনি বেরুতো, যাহ।
হঠাৎ একদিন এ সব গেল থেমে। শুরু হলো বই পড়ার নেশা আর পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা লিখে ছিঁড়ে ফেলা। সে লেখা দেখাতে না কাউকে। যক্ষের মতো কুটি কুটি কাগজ আগলে বসে থাকত, তারপর বাগানে বসে আগুন জ্বালিয়ে ছাই বানিয়ে শান্তি।
একদিন ভাটা পড়ল এতেও। তখন দুতিন দিন এক নাগাড়ে খোঁজ পাওয়া যেত না হাশেমের। দুদিন তিনদিন পরে যখন এসে হাজির হতো, তখন গা মাথা ধুলোয় ভর্তি, চোখ জবাফুলের মতো লাল। কাউকে কিছু না বলে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ত। খেতে বললে সময় মতো খেতে আসত না। দুপুরের রান্না বাসি হয়ে যেত, রাতের দুধ বেড়ালে খেতো। অনাহারে কাটত একদিন দুদিন। আবার একেকদিন সাত রাজ্যের খিদে যেন পেয়ে বসত তাকে।
মরিয়ম একদিন রাতে তার খাটের ওপরে উঠে এসে কপালে হাত রেখে বললেন, বাবা, তুই কি সন্ন্যাসী হয়ে যাবি?
কে? মা? আহ্ কাঁদছ কেন?
তোর কী হয়েছে আমাকে বলতে পারিস না?
তখন হাশেম চোখ বুজে অন্ধকারে মাকে, মার মুখ অস্থির আঙ্গুলে অনুভব করতে করতে বলল, তুমি বুঝবে না, মা।