লিখল, এখানে আবু নামে তার এক বন্ধুর কথা। লিখল, এমন একেকটা লোক থাকে যারা অচেনাও থাকে না, আবার যাদের চেনাও যায় না। তারা সর্বমানুষের অনাত্মীয় হয়ে থাকার জন্যেই যেন এ পৃথিবীতে জেদ করে বেঁচে আছে। পরে লিখল দেশের খবর আর আবহাওয়ার কথা।
এতক্ষণ চিঠি থেকে সন্তর্পণে বাঁচিয়ে এসেছে নিজের কথা। চিঠির সবশেষে ছোট্ট করে বিলকিস লিখল
খুব যে ভয় দেখাচ্ছ আমাকে! তোমাকে এ রকম বিচলিত হতে দেখলে নিজেকে আমি ক্ষমা করতে পারিনে।
পারবে আমার মতো জেদি, স্পষ্ট, শাদা একটা মেয়েকে নিয়ে সারা জীবন কাটাতে?
তোমার জন্মদিন আমার মনে ছিল। ওই দিনটা আমার কাটবে ছুটি নিয়ে; তোমার কথা মনে করে।
.
বকুলের ঠিকানা চেয়েছে হাশেম। কিন্তু আবু কোথায় খুঁজবে বকুলকে? সেগুন বাগানের। প্রতিটি বাড়ি? রেস্তোরাঁয় দুপুরে অনেকক্ষণ ধরে একটা পথ আবিষ্কারের ভাবনা ভাবল। কিন্তু কোন ফল হলো না। আজ দুদিন হলো আবু শুধু ভাবছেই। এতদিন পরে বকুলকে কী দরকার? ভাবতে থাকে আবু। যাকে ভালবেসেছিল হাশেম, পাঁচ বছর আগেই তো তাকে কবর দিয়ে চলে গিয়েছিল। আজ ফিরে এসেছে কবর থেকে মৃতমুখ তুলে দেখবার জন্যে? হাশেম ভাইয়ের ব্যাকুল মুখের কথা মনে করে আবু ভীষণ অস্থিরতায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়। রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে ফুটপাথ দিয়ে হাঁটতে থাকে মুঠি বন্ধ করে। একটা কিছু করা দরকার। খামোকা একটা শো–কেসের সামনে দাঁড়িয়ে জিনিস দেখতে থাকে আবু। দেখে না, চোখটাকে একটা কিছুতে স্থির রাখা চলে, মন বিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে। হঠাৎ রেস্তোরাঁয় ফিরে এসে টেলিফোন করে বিলকিসকে।
বিলকিস?
হ্যাঁ বলছি।
আমি আবু।
কী ব্যাপার?
বিলকিসের বুকের ভেতরটা স্তব্ধ হয়ে যায়। এই ভরদুপুরে আবু হঠাৎ টেলিফোন করল কেন? উদ্বেগ নিয়ে টেলিফোনের উপর ঝুঁকে পড়ে বিলকিস। কিন্তু অনেকক্ষণ কোন উত্তর আসে না। আবারো সে শুধোয়, হ্যালো, কী ব্যাপার?
তখন আর বলে, আমার একটা কাজ করে দিতে পারবেন?
কী কাজ?
প্রায় আর্তনাদের মত শোনায় বিলকিসের কণ্ঠ।
আবু বলে, কিছু না। একটা ঠিক না দরকার, খুঁজে দিতে হবে।
ঠিকানা?
হ্যাঁ, ঠিকানা। বকুল। প্রায় পাঁচ বছর আগে ইউনিভার্সিটিতে পড়ত। বিয়ে হয়েছে। সেগুন বাগানে না কোথায় আছে শুনেছিলাম। বড় দরকার। পারবেন? আজ–কালের মধ্যেই দরকার।
আবুর কণ্ঠের ব্যাকুলতা টের পেয়ে বিলকিস যেন অবাক হয়, তেমনি তার জন্যে কিছু একটা করতে পারার সম্ভাবনায় আগ্রহে ভরে ওঠে। নিশ্বাস ফেলে বলে, হ্যালো, আমি নিশ্চয় দেখব।
কষ্ট দিলাম।
না, না। আপনি কাল একবার খোঁজ নেবেন। কেমন?
আমেনা আবছা অবাক হলেন আবুকে দেখে। বীথিকে নিয়ে হঠাৎ আবার কিছু হলো নাকি? বীথির বাবার চিঠিটা পাবার পর থেকে তিনি বড় চিন্তিত ও সন্ত্রস্ত আছেন। উদ্বিগ্ন গলায়। শুধোলেন, এই ভরদুপুরে? মুখটা যে একেবারে তেতে উঠেছে।
আবু ম্লান হেসে বলল, এইতো, এলাম।
বিলকিসের কাছে টেলিফোন করে ভাবছিল কোথায় যাওয়া যায়।
ইউনিভার্সিটি বন্ধ। বাসায় ফিরে যাবে, যেত, যদি বীথি ও রকম পাথরের মতো বসে না থাকত। বড় চাচিমার কাছে অনেকদিন আসা হয়নি, মনে মনে ভাবল আবু। ছেলেপুলে নেই। এলে কত খুশি হন। আমেনা শুধোলেন, হাশেম কেমন আছে?
ওই রকমই। তুমি আর দেখতে গেলে না যে?
যাবো কী, বাতের জ্বালায় অস্থির হয়ে আছি, বাবা। এক পা নড়বার যো নেই।
আমেনা নিরিখ করতে থাকেন আবুকে। ভাবেন বীথির বাবা যা লিখেছেন তা কী সত্যি? কথাটা কি তিনি জিজ্ঞেস করবেন আবুকে? কিন্তু মুখে বলেন, হাশেম কিছু বলে কোথায় ছিল?
বলে, মানুষ দেখতে বেরিয়েছিলাম।
ওমা, সে কিরে?
আবু হাসল। হাসতে হাসতে বলল, ও সব তুমি বুঝবে না। বাবা, মা, এমন কী বড় চাচা অবধি হাঁ হয়ে গেল হাশেম ভাইয়ের কথা শুনে।
আমেনা সংশয়ে দুলতে দুলতে বললেন, তাহলে জ্বরের ঘোরে প্রলাপ বকছে।
প্রলাপ! একেবারে ভাল মানুষের মতো, চাচিমা। চলো, নিজে শুনে আসবে। তখন দেখব। কার কথা ঠিক।
আবু একটা ছোট্ট ছেলের মতো করতে থাকে। বড় চাচিমা ভীষণ আদর করেন তাকে। যাহ, তুই বাড়িয়ে বলছিস, হিংসুটে। কই তোর চাচাতো কিছু বললেন না।
বেশ। বলে নি তো বলে নি। আমার বড্ড খিদে পেয়েছে।
ভাত খাবি?
কী মাছ?
ভালো মাছ নেইরে। একটা ডিম করে দি?
দাও।
৫. খাবার সাজাতে সাজাতে আমেনা
খাবার সাজাতে সাজাতে আমেনা আবার বীথির বাবার চিঠিটা মনে করেন। বীথির বাবা লিখেছেন, বীথিকে আপনার কাছে এনে কিছুদিনের জন্যে রেখে দিন।
প্রস্তাবটা পেয়ে একদিকে যেমন কষ্ট হয়েছে, তেমনি খুশি লেগেছে আমেনার। হোক না কয়েকদিনের জন্যে তবু তো বীথি থাকবে তার কাছে। তার নিজের মেয়ে হলে এতদিনে। বীথির মতোই বড় হত। কিন্তু আবুর সাথে মেয়েটার যদি সত্যি সত্যি ভাব হয়ে থাকে তো আবু কষ্ট পাবে। আমেনার কষ্টটা সেইখানে।
পরে তিনি মনে মনে একটা সমঝোতায় এসেছেন। বীথি তো আর তেমন দূরে রইল না, পরের ঘরেও রইল না। আবু আসবে যখন খুশি। বরং আবু–বীথি, তখন দুজনকেই পাওয়া যাবে চোখের সমুখে।
ভাবলেন আবু হয়ত ইতিমধ্যেই শুনেছে বীথিকে নিয়ে আসা হচ্ছে এখানে, তাই আগে থেকে নিজেই পা বাড়িয়েছে তার দুয়ারে। নইলে কোনদিন আসে না এ সময়ে, এই ভরদুপুরে আজ আসবে কেন? এসেছে, পরে যেন সময়ে অসময়ে এলে অবাক না হন তিনি। ভাবতে ভাবতে আমেনার মুখে মধুর হাসি দেখা দিল।