ক্যানভাসে শাড়ির রেখা দেখে ও শুধালো, ওকী! কেন?
আমি বললাম, মাথার ভেতরে অনেক কিছু ওভারল্যাপ করছে। তুমি কথা বলো না। পোরট্রেটটা তুমি নও, ওটা আমার এক্সপ্রেশন বা ইম্প্রেশন যা বলো।
এত দ্রুত শেষ করেছিলাম ছবিটা যে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নিজেরই অবাক লাগলো। লুসিয়েন কাঁধ ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, আর সব পেইন্টারদের তুলনায় তুমি অনেক বেশি সহৃদয়। মোটেই সময় নাওনি।
আমি দাঁড়িয়ে নিরিখ করছিলাম সদ্য আঁকা ছবিটাকে। ছবিটার ডোমিন্যান্ট রং ছিল গ্রীন। গ্রীনটার স্বরূপ তোমাকে লিখে বোঝাতে পারব না।
লুসিয়েন তার বুক আমার পিঠে ঠেকিয়ে আদুরে মেয়ের মত কাঁধে মাথা রেখে ছবিটা দেখছিল। ঠিক এই সময় ভূতের মতো অগাস্টাস এসে হাজির। ভেবে দ্যাখো বিলকিস, একেবারে অপেরা থেকে কেটে আনা একটা দৃশ্য! অগাস্টাস কিছু বলল না। এক মুহূর্ত একবার আমাকে দেখল, একবার লুসিয়েনকে। আমি তো মনে করলাম, অগাস্টাস আমার ছবিখানা ইজেল শুদ্ধ তেতলা থেকে ছুঁড়ে মারবে। বদলে আচমকা ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার ওপর। অগাস্টাসের হাতে রং লেগে ছিল। ছবি আঁকছিল বোধ হয়, ফেলে রেখে উঠে এসেছে। এ রকম অনেক দিন এসেছে ও আমার ঘরে দুপুর রাতে আধ মাইল পথ হাঁটতে হাঁটতে। ওর জন্যে আমাকে মদ কিনে রাখতে হতো। আজ ওবও দুর্ভাগ্য। আমারও। পড়ে। পড়ে মার খেলাম পশুর মত। কিডনিতে একটা ঘুষি পড়েছিল বেকায়দায়, ব্যথাটা এখনো যায়নি। উলটে মারতে পারতাম, মারিনি। ভাবলাম, ও ওর পাত্র পান করুক প্রাণ ভরে।
অগাস্টাস চলে গেলে পর লুসিয়েন এসে আমার পাশে মেঝেয় হাঁটু গেড়ে বসল। আমার রক্ত দেখে অগাস্টাসের উদ্দেশে থুতু ছিটিয়ে বলল, ক্রাইস্ট। একটা পশু।
ভেজা তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছিয়ে দিতে এসেছিল লুসিয়েন। তাকে ফিরিয়ে দিলাম। সে রাগ করে চলে গেল। সকালের দিকে জ্বর এসেছিল। এখন নেই। বিছানাতেই আছি। হঠাৎ দুপুর বেলায় অগাস্টাস এসে একটা কথা না বলে আমার শুশ্রূষা করছে আনাড়ির মতো। বেচারা লজ্জা ঢাকবার জন্যে তখন থেকে গম্ভীর। দেখে হাসি পাচ্ছে।
দেখলে বিলকিস, অগাস্টাসের কাণ্ডটা?
এখন অনেকটা সুস্থ আছি।
আর কী লিখি? ভালো কথা, অগাস্টাস তোমার যে ছবি এঁকেছিল তার নাম দি বু ক্লাউড অ্যাণ্ড সেভেন্ডি নাইন কেন বলাই হলো না। ফেলরেন্সে এসে ও প্রথমে যে বাড়িটায় উঠেছিল। তার নম্বর ছিল উনআশি। কবে ছেড়ে দিয়েছে বাড়িটা, কিন্তু এখনো নাকি হোমসিক হলে তার গায়ের বাড়ির কথা মনে না হয়ে মনে পড়ে ফেলরেন্সের এই উনআশি নম্বর বাড়িটার কথা। অগাস্টাস বলে, এ হচ্ছে মনের এক অদ্ভুত খেলা। তা সেই থেকে প্রিয়তম যা কিছু। তারই প্রতীক ওর কাছে উনআশি। আব নীল মেঘ? তার ব্যাখ্যা ছবিতে, ছবি না দেখলে শুধু লিখে বোঝানো যাবে না।
অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে চিঠিটা, তাই না? তুমি এবারো যদি জবাব না দাও তাহলে সাংঘাতিক একটা কিছু করে বসবো। দাড়ি কামাতে গিয়ে গলায় ক্ষুর টেনে দিলে কেমন হয়?
আর নদিন পর আমার জন্মদিন। তোমার হয়ত মনেও পড়ত না আমি না লিখলে।
ভালো থেকো কিন্তু। নইলে ভীষণ রাগ করবো। আর তোমার পরীক্ষাটা কবে নাগাদ জানিও। তখন চিঠি লিখে জ্বালাতন করব না। কিন্তু ইতিমধ্যে চিঠি দিও।
তোমার চিঠি পাবার জন্যে নিজের ব্যাকুলতা দেখে হঠাৎ হাসি পাচ্ছে। গোটা মানুষটার জন্যেই যখন প্রতীক্ষা করছি, তখন একটা চিঠির জন্যেই এত! চিঠি না পাওয়াটাই এত অসহনীয়, তোমাকে না পেলে কী করব? এখান থেকে ভূমধ্যসাগর কিন্তু দূরে নয়। ডুবে মরা যাবে। অগাস্টাস তখন তোমার ছবির নাম বদলে হয়ত রাখবে দি বু সি অ্যান্ড সেভেন্টি নাইন।
ভালবাসা।
ইতি, তোমার মন্টি।
চিঠি শেষ করতেই আবুর কথা মনে পড়লো। চিঠি পড়তে পড়তে মন্টির মধ্যে তন্ময় হয়ে থাকার পর্দা ছিঁড়ে আবুর মুখ কেন ভেসে উঠল ভেবে পেল না বিলকিস। মনের মধ্যে মোচড় ওঠে, আবুর জন্যে কিছু করা দরকার। কিন্তু কতটুকুইবা তার ক্ষমতা?
কালকে চিরকুটে লেখা আবুর ওই কথাটা আরেকটা তারিখ নাইবা নিলেন—- একেবারে মর্মে এসে নাড়া দিয়েছে তাকে। এতকাল যা ছিল আড়ালে তার স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে এসেছে। বেরিয়ে এসে বিব্রত করে দিয়ে গেছে বিলকিসকে। তা হাত পা বাঁধা। আবুর জন্যে মমতা হয়, কিন্তু হাত ওঠাতে গেলে যে টান পড়ে; মন্টি তার সর্বস্ব নিয়ে এত ভরসা করে আছে। বিলকিসের মনের ভেতরটা খুব অসুখী হয়ে থাকে। জগৎ জোড়া একী নির্মম পরিহাস! লুসিয়েন অগাস্টাস এদের কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে, লুসিয়েন তার বিরাগ দিয়ে শক্তি জোগাচ্ছে অগাস্টাসের। বিলকিস ভাবে তার বিরাগেও কি শক্তিমান হয়ে উঠতে পারে না আবু
.
আবুকে অনেক কিছু করতে হবে। অনেক বড় হতে হবে। অমন সংবেদী ছেলেটা ইচ্ছে করলে অনেক বড় হতে পারে। বিলকিসের মনে হয়, তার যদি কোন অলৌকিক শক্তি থাকত তাহলে এই মুহূর্তে আবুকে পৃথিবীর সবসেরা মানুষ করে দিত।
রাতে চিঠির জবাব লিখতে বসলো বিলকিস। লিখবার আগে আরো দুবার পড়ল চিঠিটা; যেন যথেষ্ট করে অনুভব করে নিল মন্টিকে। বারোয়ারি কথায় ঠাসা জবাব। লুসিয়েনকে বকলো খানিক অগাস্টাসকে ভোগাবার জন্যে। অগাস্টাসের জন্যে দুঃখ করল তার ছবি বিক্রি হয় না বলে। লিখল, সেদিন ভোর রাতে অগাস্টাস মারপিট করে ভালই করেছে, নইলে। নিজেরই ওপরে প্রতিশোধ নিত। সেটা হতো আরো ভীষণ। মন্টি তার ঝড় আগলে সুবুদ্ধির পরিচয়ই দিয়েছে।