বেরিয়ে এসে বিলকিস বারান্দায় মোড়া পেতে বসল। শিশু সন্ধ্যের আভাস লেগেছে আকাশে। চারদিক ভারী শান্ত। মোড়ায় বসেই চা খেলো।
তারপর হাঁটল খানিক নিচেয় ঘাসের ওপর। ফিরে এসে ছোট বোন পারিজাতের সঙ্গে আদর খেলা করল। ছোট ভাগৃনে দুটো এসেছে কাল। টুকু আর টুলু। তারা তখন ভাঙ্গা চক দিয়ে মেঝেয় সোৎসাহে পাখি আঁকছে আর ছড়া কাটছে—-
দ গেলো শ্বশুর বাড়ি
বসতে দিল কাঠের পিড়ি।
তাদের কোল সাপটা করে নিয়ে সোফার ওপর বসল বিলকিস। গাল টিপে দিয়ে বলল, লক্ষ্মীছাড়া হয়েছিস দুটো।
তখন খিলখিল করে হাসতে হাসতে টুকু নেমে এলে বিলকিসের পায়ের ওপর। সেখানে বসে সে দোল খাবার চেষ্টা করতে লাগল। আর টুবলুও কিছু কম যায় না। সে বাহুর ফাঁক দিয়ে একেবারে কাঁধের ওপর উঠে বাতাসে সাঁতার দিতে লাগল।
টুকু আর টুবলুকে নিয়ে কাটানো গেল অনেকক্ষণ। তারপর নিজের ঘরে এসে মন্টির চিঠিখানা খুলে পড়তে বসলো। প্রথমেই লম্বা এক অভিযোগ!
আগের চিঠিটার জবাব দাওনি কেন? তোমার চিঠির জন্যে তাকিয়ে থেকে থেকে ঘাড় ব্যথা। করতে শুরু করে দিয়েছে। ডাকপিয়নটার কাছে পর্যন্ত লজ্জা পাচ্ছি। ওর সাইকেলটা মোড়ের মুখে দেখলেই এখন আমি পালাই।
বড্ড নিষ্ঠুর হয়েছ তুমি।
অথচ এদিকে তোমাকে নিয়ে কত কাণ্ড! আমার বন্ধু অগাস্টাস—- সেই যে ছেলেটা, যার কথা এর আগে তোমার কাছে লিখেছিলাম, একটা সোলো একজিবিশন করে ক্রিটিকদের কাছে। দারুণ বকা খেলো সেই অগাস্টাস এক কাণ্ডই করে বসেছে। আমার কাছ থেকে ফোটো নিয়ে তোমার ছবি এঁকেছে। নাম দিয়েছে দ বু ক্লাউড অ্যাণ্ড সেভেন্টি নাইন। অদ্ভুত এই নামটার একটা মজার ব্যাখ্যা আছে।
এবার হাতে টাকা এলেই অগাস্টাস তোমার কাছে ছবিটা পাঠাবে। ওর ছবি কেউ কিনতেই চায় না! যা বিক্রি হয় তাতে ওর কালো রুটি, মদ আর বাড়িউলিকে ভাড়া দেয়ার পয়সা হয় কোনো রকমে। তাই ভাবছি, ছবিটা শেষ অবধি তোমার কাছে পৌঁছুবে কিনা। ওকে বললাম, ছবির অন্তত একটা ফোটো তুলে পাঠাই।
তাতে চটে গিয়ে বলল, আড়াই বাই চার ইঞ্চি এক চিলতে কাগজে শাদা কালোয় আমার ছবির কংকালটাই পাবে।
লুসিয়েন কিন্তু অগাস্টাসকে ভোগাচ্ছে খুব। মেয়েটা যেন ওকে মানুষ বলেই গনতে চায় না। অগাস্টাসের এই হাল দেখে একেক সময় লুসিয়েনের ওপর এত চটে যাই যে তখন হাত নিসপিস করতে থাকে। মনে হয়, কী হয় পৃথিবীর, এই মেয়ে জাতটা না থাকলে?
তুমি ভাবছ, আমার মানসিক অধঃপতন দেখা দিয়েছে। না, না। অগাস্টাসকে দেখলে রাস্তার ষ্ট্যাচুটার পর্যন্ত দুঃখ হতো, আর আমি তো জ্যান্ত মানুষ! অথচ ছেলেটা এমন, বাইরে কিছু বলবে না, ভেতরে ভেতরে যে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে সে ছাই সোনার পাত্র দিয়ে ঢেকে রাখবে। আমি বলি, লুসিয়েন একদিক থেকে ভালোই করছে অগাস্টাসের। নইলে ওর ছবি আঁকাই হতো না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেমন করে ছবি এঁকে চলে, দেখলে অবাক হতে হয়। শক্তি পায় কোত্থেকে? আমি বলি—-লুসিয়েন।
দ্যাখো কী কাণ্ড! একটু আগে লুসিয়েনের সূত্র ধরে তামাম মেয়ে জাতটাকে মন্দ বলছিলাম। এখন আবার তারই সুখ্যাতি করছি।
কলম তুলে ভাবলাম খানিক, কেন এমন হলো?
মনে হচ্ছে, একবার ব্যক্তি হিসেবে একবার শিল্পী হিসেবে দুরকম করে অগাস্টাসকে দেখছি বলেই এই গরমিল। কোনটাকে বড় করে দেখব? কী জানো বিলকিস, শেষ অবধি হয়ত মানুষটাকে বড় করে দেখা উচিত। মানুষটাই যদি কষ্ট পেল তাহলে এত হৈচৈ আয়োজন কার জন্যে? নামের মোহ যাদের আছে তাদের আলাদা কথা। তারা পেলেও যা, না পেলেও সেই একই। কিন্তু নামের মোহ যাদের নেই?
মানুষ বাঁচে বলেই তো পৃথিবীটা বাঁচে। যে মানুষ আজ মরে গেল, তার কাছে এ পৃথিবীর শিল্প সভ্যতা সুখ–দুঃখ সব কিছুই মরে গেল।
যতটুকু বেঁচে আছি, আনন্দ থাক। তাইতো বারবার তোমাকে বলি, আমাকে আর দূরে সরিয়ে রেখো না।
তোমার অন্তরটাকে আমার আপন করে নিতে দাও, যেন মৃত্যুর সময় আমাকে দুঃখ করতে না হয়।
কথায় কথায় কতদূর চলে এসেছি!
অগাস্টাস কাল ভোর রাতে আমাকে বেদম মার দিয়েছে। নাক দিয়ে রক্ত ছুটছিল। কাল সন্ধ্যেয় লুসিয়েনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। ও এসেই বলল, আজ তোমার সঙ্গে আমার তারিখ।
আমি তোমার কথা মনে করে বললাম, আমার তারিখ তো হয়ে আছে, লুসিয়েন।
সে বলল, কুছ পরোয়া নেহী! তোমরা অমন একরোখা প্রেমিক কেন, মন্টি? আজ আমি তোমার মেয়েটার কাছ থেকে একটা দিন ছিনিয়ে নিতে এসেছি। ঠিকানা দিও, তাকে না হয় ফুল পাঠিয়ে ভাব করে নেবো পরে।
কী ভাবছ বিলকিস? ভাবছ, তোমার কথা দশখানা করে বলে বেড়িয়েছি সারা ফেলরেন্স? ভরসা আছে, তা যদি বলেই থাকি তুমি চটে যাবে না। আর এক্ষেত্রে বলিইনি। লুসিয়েনের আন্দাজ ভালো।
গলায় লুসিয়েনের হাত। তোমার কাছে স্বীকার করতে সংকোচ নেই, তখন আমার একটু ঘোর লেগেছিল যেন। নইলে পরক্ষণেই লুসিয়েনকে নিয়ে হৈচৈ করে বেড়িয়ে পড়লাম কেন?
দ্যাখো, অভিমান করতে যেও না যেন, লক্ষ্মী। আমি বলছি বলেই তো জানতে পারছ, নইলে জানতেও না। কথা দাও, আমাকে ভুল বুঝবে না। নইলে এই আমি কলম বন্ধ করলাম।
জানি, তোমার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে। আমি তো জানিই, তোমার কাছে প্রশ্রয় আছে সব কিছুর।
তারপর রাতে ঘরে ফিরে লুসিয়েনের ছবি করতে বসেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল, এই ছবিটা আঁকতে না পারলে লুসিয়েন থেকে যেন আমার নিস্তার নেই। রাত তখন অনেক। লুসিয়েনের পোরট্রেট করছি। শাড়ি পরা লুসিয়েন। দূরে টুলের ওপর পরিতৃপ্ত পোষমানা বেড়ালের মত এতক্ষণ বসে ছিল লুসিয়েন।