দুপুরে মাহবুব এলো হাশেমকে দেখতে। তার আগে সকালেই মাহবুবের বউ ফাতেমা এসেছিল। আজ ওরা দুজন এখানেই খাবে।
হাশেম মাহবুবকে দেখে বলল, কিরে, ভালো আছিস?
ঐ এক রকম।
মাহবুব মাথা নিচু করে উত্তর দেয়। ওর ওটা একটা স্বভাব। কথা বলতে গিয়ে, সে যে হোক না কেন, যে কথাই হোক না কেন, কেমন যেন লজ্জিত হয়ে পড়বে।
পুরনো স্বভাবটা এখনো যায় নি দেখে হাশেমের ভারী চেনা মনে হলো মাহবুবকে। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটা অমন। হাশেমের মনে হলো ছোটবেলার মাহবুবকে এক অলৌকিক বলে সে ফিরে পেয়েছে। যেন আর একটু পরেই মাহবুব বেরিয়ে গিয়ে মাঠে দাঁড়িয়ে ও পাড়ার ছেলেদের ব্যাডমিন্টন খেলা দেখতে লেগে যাবে। ফিরে এসে বায়না ধরবে আমাকেও র্যাকেট কিনে দাও, কর্ক কিনে দাও।
হাশেম বালিশটাকে পিঠের নিচে এনে মাথা উঁচু করে শুলো। মৃদু হেসে বলল, তোর বউ দেখলাম।
হাশেম চলে যাবার বছর তিনেক পরে বিয়ে করেছিল মাহবুব। কাজেই এই প্রথম দেখা।
—-ভারী লক্ষ্মী বউ পেয়েছিস।
মাহবুব মুখ নিচু করে আঙ্গুল দিয়ে চাঁদর খুঁটতে খুঁটতে শুধালো, তুমি এতদিন ছিলে কোথায়?
হাশেম হাসলো। হাসলো নাতো যেন অন্ধকারে একরাশ ফুলসৃস্টির ভ্রম হলো।
—-বাবা মা কাঁদতে কাঁদতে মরতে বসেছিলেন তোমার জন্যে।
মানুষ তো কাঁদতে জানে বলেই বেঁচে থাকে, মাহবুব। কান্নাটা হচ্ছে মানুষের একটা শক্তি। বুঝতে পারছিস?
মাহবুব নির্বাক হয়ে শোনে। হাশেম বলে, ব্যথা পেলেই কাঁদে। কান্না হচ্ছে ব্যথার রূপ। ব্যথাটাকে বুঝতে না পারলে কাঁদতে পারবি কেন? মানুষ তো এমনিতেই কাঁদে, কাঁদে না? হাত পা ছড়িয়ে আকুলি বিকুলি করে, বিচ্ছিরি সংস্কারের মতো। সংস্কারটাকে বাদ দিয়ে যে কান্না ওটাই শক্তি।
মনে মনে অস্বস্তি বোধ করে মাহবুব। সত্যি সত্যি হাশেম যে পাগল হয়ে গিয়েছে এইটে অবিশ্বাস করবার আর কোনো কারণ সে দেখতে পায় না।
ঠিক এই কথা যখন সে ভাবছিল, তখন তাকে চমকে দিয়ে একেবারে সুস্থ মানুষের মতো হাশেম ঘরোয়া প্রসঙ্গ ওঠায়। বলে, কী করছিস আজকাল? মা চাকরির কথা বলছিলেন।
হ্যাঁ।
আজ আপিস যাসনি?
ট্রেনিং-এ আছি।
মাহবুব রান্নাঘরে এসে মরিয়মকে জানাল, মা, ভাই দেখছি বদ্ধ পাগল।
চটে গেলেন মরিয়ম। বললেন, হ্যাঁবে, তোদের মুখে কি আর কোন কথা নেই? পাগলই তো! নইলে কী সব বকছে শুনে এসোগে।
মাহবুব আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল জোর দিয়ে, হঠাৎ চোখে পড়ল তার বউ ফাতেমা চোখ টিপে বারণ করছে।
আমার ছেলে পাগল আছে বেশ আছে।
বলতে বলতে মরিয়ম যেন আঁচল দিয়ে অশ্রুই মুছলেন।
বিলকিস সারা ইউনিভার্সিটিতে উৎসুক হয়ে খুঁজল আবুকে। কিন্তু কোথাও দেখা মিলল না তার। সে বাসায় না থাকাতে আবু চটে গেছে কাল। তার প্রমাণ ছোট্ট চিঠিটা। চিঠির সেই কথা—-আরেকটা তারিখ নাইবা নিলেন। চিঠি পেয়ে বিলকিস যেমন বিস্মিত হয়েছে, তেমনি মনে মনে নিজের কাছে ছোট হয়ে গেছে সে। মনে হচ্ছে কাল কথা দিয়ে অমন করে না বেরুলেও পারত। কিন্তু সে তো বুঝিয়ে লিখে রেখে গিয়েছিল। কিছুতেই যেন বুঝতে পারছিল না বিলকিস, হঠাৎ করে মানুষটার গিয়ে লাগল কোথায়? তবে সে কি যা আশঙ্কা করেছিল তা–ই সত্যি? আবু তার হৃদয়কে বাসনা করছে?
বিলকিস তখন নিজের নারীত্ব নিয়ে যেন বিষ বিব্রত বোধ করল। তারপর সারাদিনে ক্লাশের চাপে আর কিছুই মনে রইল না তার। সারাটা দিন ক্লাশ করে, লাইব্রেরীতে পড়াশোনা করে বাইরে যখন বেরুল তখন মনে মনে বলল—- আরেকটা দিন পার হয়ে গেল। বিকেলের রাঙ্গা রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে নিজেকে মুগ্ধ হতে দিল বিলকিস। এই রৌদ্রটা শুধু এই সময়ের; আর কোন দিন তা ফিরে আসবে না। এক অপরূপ আনন্দ ও বেদনার আশ্রয়ে সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল আমগাছটার নিচে। আজ তার গাড়ি আসতে বড় দেরি হচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ দেখে বিলকিস রিকশা নিয়ে বাড়ি ফিরল। দ্যাখে, টেবিলের ওপর চিঠি। হাতের লেখা আর স্ট্যাম্প দেখে তক্ষুণি বুঝতে পারে ফ্লোরেন্স থেকে মন্টি চিঠি লিখেছে। ইস, এর আগেও মন্টি আরেকটা চিঠি দিয়েছিল। তার উত্তর দেয়া হয়নি। নিজের আলসেমিকে মনে মন নিন্দা করল বিলকিস। চিঠিটা তক্ষুণি খুলল না। তুলে নিয়ে রেখে দিল হাতব্যাগে।
বাথরুমে এসে মুখ মার্জনা করল। তারপর আয়নায় শাদা তোয়ালে জড়ানো মুখটার দিকে তাকিয়ে রইল বিলকিস। যেন নিজের মৃতমুখ দেখছে, এমনি অপলক দৃষ্টি তার।
মন্টির মুখ অদ্ভুত রকমে রেখা ও কোণবহুল। আবছা আবছা মনে পড়ে বিলকিসের। আর রংটা গাঢ় তামাটে। দেখলে মনে হয়, একটা আবক্ষ মূর্তির দর্শন ঘটলো, বিশেষ করে মন্টি যখন চোখ বুজে থাকত। কথ বলতে বলতে অনেকক্ষণ চোখ বুজে থাকা, চোখ বুজেই কথা বলা মন্টির একটা স্বভাব। বিলকিসের মনে হতো তখন, মন্টি যেন চোখ বুজে দেখে নিচ্ছে যা বলছে। মন্টি বলত, পৃথিবীটার কোনো হারমনি নেই, বিলকিস। প্যাটার্ণ নেই, প্রাণ নেই। চান্স ইরেকটেড, চান্স ডাইরেকটেড। দেখে দেখে আমার গা জ্বালা করে। তাই তো ছবি আঁকি। চারটা ফ্রেমের মধ্যে যে পৃথিবী সৃষ্টি করলাম, তার ভেতরে বস্তুর প্রাণের হারমনি আছে, এইটে বড় কথা।
বিলকিসের অনেক দিন মনে হয়েছে, মন্টির চোখ বুজে থাকার অভ্যেসটা এখান থেকেই পাওয়া। এ যেন বাইরের পৃথিবী থেকে চট করে সুইচ অফ করে তার নিজের পৃথিবীতে চলে যাওয়া।