ডাকে আর ঝরঝর করে কাঁদতে থাকে। কেন কাঁদছে তা সে নিজেই বুঝতে পারে না। কিন্তু মরিয়মকে জড়িয়ে ধরে বুক ভরে কেঁদে পরম এক নির্ভরতা ফিরে পায় বীথি। দুজনের ভেতরে একটা বোঝাঁপড়া হয়ে যায় যেন অলক্ষিতে।
মরিয়ম তার কপালে, চুলের ভেতরে, বুকে হাত বুলিয়ে তার মুখের ওপর নিজের গাল চেপে ধরে কান্নাভেজা কণ্ঠে বলেন, বীথি, তুই আমার কাছেই থাকবি। তোকে কোথাও যেতে হবে না। সোনা আমার, চুপ কর, চুপ কর একটু।
ভোর রাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আবুর। আর একটু পরেই উঠবে আর একটি দিনের সূর্য। এখনো আকাশ থেকে আঁধার কাটেনি। এখনো ভালো করে ঠাওর করলে একটি দুটি তারা আবিষ্কার করা যাবে। আর বইছে কী নির্মল বাতাস। বিলকিসকে মনে হয় এই নিঝুম নিস্তরঙ্গ ভোরের মতো অস্পষ্ট, বিশাল, দৃষ্টির অতীত, রহস্যময়। তখন আকাশের মতো শুদ্ধ এবং গম্ভীর একটি বেদনা যেন বিলকিসের নাম হয়ে জন্ম নিল আবুর মনে।
অপূর্ণ, অক্ষম একটা পুঞ্জীভূত ইচ্ছার চাপে আবুর ভেতরটা ভারী হয়ে উঠছে। যেন সে ভীষণভাবে পরাজিত হয়ে গেছে কাল বিলকিসের কাছে। যে স্রোতটা উৎস থেকে লাফিয়ে গড়িয়ে এতকাল চলছিল, হঠাৎ একটা পাথরের মুখে পড়ে তা স্তব্ধ হয়ে গেছে যেন! মরে যাওয়াই তো ভালো। কী ক্ষতি হবে কার, এখন যদি মরে যায় আবু? যাকে রক্ত দিয়ে ভালোবাসা গেল, সে যদি চিরকাল রইল দেয়ালের আড়ালে, তাহলে শুকিয়ে যাক রক্তের ধারা। কাল বিলকিসের সঙ্গে দেখা হলো না বিধাতার কোন্ অজ্ঞাত ইচ্ছায়? স্তব্ধ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে আবু। দূরে, ছড়ানোমেলানো শহরটা কী অপরূপ শান্তিতে শুয়ে আছে। বিলকিস কি কখনো জানতে পারবে, তার জন্য মরে যাচ্ছে আবু? আস্তে আস্তে আকাশটায় লাগছে শাদা রং। বীথি বালিশ থেকে বিছানায় মাথা রেখে আচ্ছন্ন হয়ে ঘুমিয়ে আছে। বালিশের ওপর মেলানো তার চুল। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় বীথির মুখ এক মুঠো মমতা হয়ে আছে। কাল রাতে মরিয়ম শুয়েছিলেন এ ঘরে। একটু আগে উঠে গেছেন ফজরের নামাজ আদা করবার জন্যে। ওপাশের বারান্দা থেকে শব্দ আসছে তার ওজুর।
দরোজা ঠেলে খাটের পাশে এসে বসলো আবু। খোলা দরোজা দিয়ে এলো হাওয়া। হাওয়ার ঝলকে বীথির কোমল মুখোনা যেন অবগাহন করে উঠলো।
বিলকিসও এখন শুয়ে আছে এমনি করে। বালিশ থেকে হয়তো তার মাথাও ঘুমের ঘোরে নেমে এসেছে। শিয়র ভরে উঠেছে একরাশ খোলাচুলের ঐশ্বর্যে। বুকটা উঠছে নামছে।
আবু করতল দিয়ে সন্তর্পণে স্পর্শ করল বীথির গাল। মনে মনে বলল, ঘুমিয়ে থাক, ঘুমিয়ে থাক, আমাকে দেখতে দে।
বীথির মুখ দুহাতে তুলে বালিশে রাখতে গেল আবু। বীথি চোখ মেলল। চোখ মেলবার আগে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরল আবুকে।
আমি, বীথি।
একটু পরে সে বলল, কাল রাতে কী হয়েছিল রে?
আবুর কণ্ঠ ভোরের মত আবছা আবছা, তেমনি সুদূর।
কী হয়েছিল তোর? কাঁদছিলি কেন?
বীথি পরিপূর্ণ চোখ মেলে তাকাল আবুর দিকে।
—-আমার ঘরে শুয়ে থেকে শুনছিলাম তুই কাঁদছিস। মনে করলাম তোর কাছে উঠে আসি। কিন্তু তুই যে মেজাজ করেছিলি কাল। এলে কি আমাকে তাড়িয়ে দিতি?
বীথি কথা বলে না। চুপ করে থাকে দুজনে। আবু বীথিকে করতল দিয়ে স্পর্শ করে থাকে। কপালে হাত বুলিয়ে দেয়। বলে, আমাকে একবার ডাকলে কি আসতাম নারে?
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আবু।
হঠাৎ বীথি মুখ ফিরিয়ে নেয়। আবুর করতল থেকে নিজেকে সরিয়ে বালিশের ওপর বলে, তোমাকে কি আমার সব কথা বলতে হবে?
না তাকিয়েও বীথি অনুভব করতে পারে, আবু আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল।
৪. বারান্দায় এসে হাশেমের মুখোমুখি
বারান্দায় এসে হাশেমের মুখোমুখি পড়ে যায় আবু। দ্যাখে, দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাশেম। যেন আবুর জন্যেই অপেক্ষা করছে সে।
হাশেম ডাকল, আবু, শোন।
চোখ তুলে দেখল, থরথর করে কাঁপছে, দুপয়ে দাঁড়াতে পারছে না হাশেম। দুচোখ ফেটে যেন কিসের ব্যাকুলতা ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আবু হাত বাড়িয়ে ধরলো তাকে, নইলে বোধ হয় মুখ থুবড়ে পড়েই যেত মানুষটা।
একটা কাজ করতে পারবি?
তার কথায় কান না দিয়ে আবু বলে, বিছানায় চলো। না কি একটা ইজিচেয়ার পেতে দেব? জ্বর একটু কমেছে বলেই উঠতে হয় নাকি?
ম্লান হাসিতে সূর্য হয়ে ওঠে হাশেমের মুখ। বলে, নারে না, আমার কিসসু হয়নি। শরীরটা কেবল মনের ওপর শোধ নিচ্ছে। অনেক দিনের রাগ কিনা! তোরা তাও হতে দিবিনে? আমার কিসসু দরকার নেই।
মুখে যতই বলুক, দুর্বলতার ঘোরে স্পষ্ট টলতে থাকে হাশেম। আবুকে শক্ত করে ধরে শুধোয়, বকুলের খবর জানিস, আবু? বকুল কোথায় আছে?
হাশেমের মুখে বকুলের নাম শুনে চমকে ওঠে আবু। একমুহূর্ত কোন জবাব দিতে পারে না। বকুল বকুলের সংবাদ সে জানবে কী করে? বকুলকে সে দেখেও নি কোনোদিন। বকুল তার কাছে কেবল একটা নাম ছাড়া আর কিছুই না। শুনেছিল, বছর খানেক আগে তার বিয়ে হয়ে গেছে।
আবু বলল, ঢাকাতেই আছে শুনেছিলাম। সেগুনবাগানে না কোথায়।
আমাকে আজ ঠিকানাটা এনে দিতে পারবি?
আবু অবাক হয়ে ভাবে, হাশেম ভাই কী জানেন বকুলের বিয়ে হয়ে গেছে? কথাটা জানাতে গিয়েও সাহস হয় না হাশেমের চোখে সাত রাজ্যের আকুলতা দেখে। সে আশ্বাস দিয়ে বলে, আচ্ছা দেখব।
হাশেম তখন স্বস্তি পেয়ে আবুকে ছেড়ে দিয়ে ঘরের দিকে এগোতে চায়, কিন্তু পারে না। মাটিতে পড়ে যাবার আগেই আবু তাকে বুক দিয়ে জড়িয়ে ধরে। বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দেয়। কী জানি কী হয়, বিছানায় শুয়ে ঘামে, অস্থিরতায়, জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। হাশেম যেন অনেক বড় একটা মাঠ পাড়ি দিয়ে এসেছে। বড় বড় চোখ মেলে আবুর দিকে তাকিয়ে থাকে। আবু আবার বলে, আচ্ছা, দেখব আজ।