বীথি তাকে অনুসরণ করে।
বাগানের সিঁড়িতে হাত ধরে বীথিকে বসায় আবু। আর নিজে হাঁটতে থাকে অন্ধকারে। অন্ধকারে দাঁড়ানো গাছের ভেতর দিয়ে। ভেতর থেকে বেরিয়ে তারার অস্পষ্ট আলোর ভেতরে।
আবু আপন মনে বলে, তোকে কেন ডাকলাম, বীথি?
আর্তনাদের মতো শোনায় যেন আবুর কণ্ঠস্বর। বীথির মায়া হয়। তোকে কেন ডাকলাম? তোকে কি ডাকতে চেয়েছি? আজ এই রাতটা আমাকে যেন জ্বালিয়ে মারছে। মনে হচ্ছে, আকাশ থেকে আগুন ঝরে আমার একা অন্তরটাকে খাক করে দিচ্ছে। কী করি বলতো? বড়ড ভয় করছে। এক মুহূর্তের জন্যে ভুল হলো, যেন তুই আমাকে শান্ত করতে পারবি। কিন্তু তা হচ্ছে কই?
আবু এসে তার পাশে বসে। বলে, তোর হাতটা দে।
বলে নিজেই বীথির হাতটা টেনে নেয়।
তোর ভয় করছে, বীথি?
না।
তাহলে হাত কাঁপছে কেনরে?
হাতটা ফেলে দেয় আবু। খেদ ভরা কণ্ঠে বলে, আমার হাতে সাহস নেই, বীথি। নইলে সবাই অমন দেয়াল তুলে রাখে, দেয়ালটা ভাঙতে চাই, পারি না। আমাকে দিয়ে কিস্সু হবে না, দেখিস তুই।
বীথি চুপ করে শোনে। বলে, তোমাকে দেখে আমার ভয় করে, আবু ভাই। হাশেম ভাইয়ের। মতো তুমিও না একদিন ঘর ছেড়ে বেরোও।
আবু ওর চোখে চোখে তাকায়।
তোরও কি তাই মন হয়, বীথি?
তুমি একটু ভালো থাকতে পারো না, আবু ভাই? আমি যদি কিছু করতে পারি, বলো। বীথির কণ্ঠ স্পর্শ করে আবুকে। এক মুহর্তের জন্যে চমকে ওঠে। পরে বলে, আয় তাহলে। বীথিকে বুকের ভেতরে চেপে ধরে আবু। চুলের ভেতরে মুখ রেখে বলে, আমার চোখ ঢেকে দে, বীথি! আমার যে কী হয়েছে, খালি অস্থির লাগছে।
বীথি চুপ করে পড়ে থাকে খানিকক্ষণ। তার কানের ভেতর দিয়ে আত্মায় এসে ঘা দিচ্ছে। আবুর হৃদস্পন্দনের শব্দ। শব্দটা অলৌকিক মনে হয়। মনে হয়, আরেক পৃথিবী থেকে সাংকেতিক বার্তা আসছে।
অস্থির হয়ে ওঠে বীথি।
আবু তাকে ঠাস্ করে ছেড়ে দিয়ে বলে, তুইও পালালি। কী শূন্য হয়ে আছে এইখানটায়। থাকতে পারলি না তো।
বীথি দুহাত দিয়ে নিজের মুখ ঢাকে।
আবু উঠে দাঁড়ায়। বলে, বলেছি, তোকে জ্বালাবো না। জ্বলতে এলি কেন? আমার মুখের ওপর দরোজাটা বন্ধ করে দিতে পারলি না?
আবু অন্যমনস্কভাবে খুব করে হাঁটতে থাকে বাগানে। ফিরে এসে বলে, তুই আমাকে ছুঁয়ে যাবার স্পর্ধা করেছিস, বীথি। কিন্তু আমি তোকে নিয়ে খেলা করছি বুঝতে পারলি না কেন? হ্যাঁ, সত্যি। আমার চোখের ভেতরে তুই নেই। তাকিয়ে দ্যাখ।
বীথি হাঁটুর ভেতরে মুখ লুকোয়।
আবু বলে চলে, আমি তো বুঝি, মানুষের এ কষ্টটা কী ভীষণ। মরে যাবি তুই। আমাকে কষ্ট জ্বালানোর কাজ দিনে বীথি। তাতে আমার আরো কষ্ট। দেখছিস না, কিসের যে নেশা আমি নিজেই জানি না, তবু কষ্ট হয় শুধু। যদি লাফ দিয়ে মরতে পারতাম তো ভালো হতো। কিন্তু সে সাহসও নেই।
বীথিকে হাত ধরে তুলে আনে আবু।
তোর মুখ দেখে মায়া হয়। চল বাগানে একটু হাঁটবি।
কাটা কবুতরের মতো বিছানায় পড়ে ছটফট করতে থাকে বীথি। মাথার ভেতরে যেন একপাল যন্ত্রণা সোর বাধিয়েছে। না থামানো যায়, না সহ্য করা যায়।
অস্ফুট আর্তনাদ করতে থাকে মাথার দুরগ টিপে। হারিয়ে যেতে চায় বালিশে ব্যর্থ মুখ লুকিয়ে। ডান হাতটা কেবলি এপাশ ওপাশ করতে থাকে যেন এমনি করলে, যে ছবিগুলো মনের পর্দায় ফিরে আসছে, তারা মুছে যাবে।
মরিয়ম এসে ডাকলেন, ঘর অন্ধকার কেন, বীথি? ঘুমোলি নাকি? খাবিনে?
হঠাৎ শুনতে পেলেন বীথির কাতর শব্দ। বুঝতে পারলেন না সেটা তাঁর মনেরই ভুল কিনা। তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে মেয়েটার মাথায় হাত রাখলেন। ইস, কী ঘামছে।
বীথি, বীথি রে।
মা।
অস্ফুট ডাকটা শুনে বিহ্বল হয়ে গেলেন মরিয়ম। একেবারে খাটের ওপর উঠে বীথির মাথাটা কোলের ভেতরে তুলে নিয়ে বললেন, এই তো মা, এই যে আমি। কী হয়েছে, সোনা আমার? কিছু না, কিছু না! তুমি কেন এলে, চাচিমা?
মরিয়মের বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। বীথি কেন এমন করছে বুঝতে না পেরে, আকুলি বিকুলি করতে থাকেন। যেন নিজের মেয়েটা, যদি নিজের মেয়ে থাকত মরিয়মের, তাহলে আজ তার কোলে মাথা রেখে এমনি কাতরাতো।
আমাকে তুই বলবিনে কী হয়েছে?
হঠাৎ ভয় পান মরিয়ম। আজ বিকেলে খোরশেদ চৌধুরী যে কথা আবুর বাপকে ডেকে বলেছেন, বীথির কানে তা যায় নি তো?
যাবার সময় তিনি বলে গিয়েছিলেন, কথা যখন উঠেছে মোরশেদ, তখন সত্যি না হলেও মিথ্যে বলে উড়িয়ে দিও না। ছোট মিয়া লিখেছে, বীথিকে হোস্টেলে দেবে। আমারও মনে হয়, কিছুদিনের জন্যে অন্তত বীথিকে দূরে সরিয়ে রাখা ভালো। এখন কিছু বলো না। মেয়েটাকে। দিন দুই পরে আমার বাসায় দিয়ে এসো। তারপর ওর বাবা এসে যা হয় করবে। হাজার হোক মেয়ে তো ওর।
কথাটা শুনে অবধি পাথর হয়ে গিয়েছিলেন মরিয়ম। এই মেয়েটা যে তাকে ছাড়া আর কিছুই বুঝতো না, এই ব্যথাটা যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। এমনকি এই সেদিনও এক মাস থাকবে বলে বাড়ি গিয়েছিল বীথি। কিন্তু মাত্র পনেরো দিন পরেই তার বাবা তাকে নিয়ে ফেরৎ এসেছেন।
তিনি এসে বলেছিলেন, আপনিই ওর মা হয়ে গেছেন, ভাবী। মেয়ের মন যেন টিকতেই চায় না আমাদের ওখানে।
সে কথা মনে করে মরিয়মের এখন ভীষণ কান্না পায়। বুকের ভেতরে জড়িয়ে ধরেন বীথিকে। বীথিও তাকে আঁকড়ে ধছে কাতরাতে থাকে, চাচিমা, চাচিমা গো।