এর কদিন পরেই বীথিকে নিয়ে আবার বেরোনোর উদ্যোগ করে আবু। বীথি বাধা দেয়। বলে, আমার সময় নেই।
ইস্, আজকাল বড়ড সময়জ্ঞান হয়েছে তোর।
হবে না?
বীথি তখন মনে মনে ভাবছে, শুধু শুধু কষ্ট এনে লাভ কী? তার চেয়ে এই ভালো, এই ভেতরের মরে যাওয়া, জেদ করে বসে থাকা। আবুর দিকে তার মন লতিয়ে উঠতে শুরু করে। দিয়েছে। তার শেকড় কেটে ফেলার পণ করে বীথি। কিন্তু কিছুতেই ফেরানো যায় না আবুকে। বেরুতেই হয়। অনিচ্ছার সংগে আপোষ করতে গিয়ে সে নিশ্ৰুপ হয়ে রইলো সারাক্ষণ।
আবু সারা রাস্তা ধরে কী বকতে থাকে তার একবর্ণ কানে যায় না বীথির। রিকশায় তার পাশে চুপ করে বসে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে পিছিয়ে পড়ে। আবুকে বারবার থেমে ধরতে হয়। পার্কে বেঞ্চে পাশাপাশি বসেও মনে হয়, বীথি একাই বসে আছে, আৰু আবু সমানে কথা বলে। এক আধটা হ্যাঁ না ছাড়া আর কিছু বলার উৎসাহ পায় না বীল নিজেকে বড় একা আর নিঃস্ব মনে হয় তার।
আবু চটে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমি একটা ছোটলোক। বুঝলি, আমি একটা ছোটলোক। আমার সংগে বেরোস কেন?
আসলে বীথির ব্যবহার দেখে যে রাগটা হচ্ছিল, সেটা নিজেকে বকে মেটায়। হন্ হন্ করে চলে যায় তাকে সত্যি সত্যি একলা ফেলে। বীথির তখন খুব খারাপ লাগে। নিজের জেদ দেখে নিজেকেই আর পছন্দ করতে পারে না। মনটা বলতে থাকে, দৌড়ে গিয়ে মানুষটাকে ডেকে আনতে। মনে হয় আবুর সামনে আছাড় খেয়ে পড়ে বলে, আমাকে নিয়ে তুমি যা খুশি করো। তোমার যাতে সুখ আমারো তাতে অন্তরের সায়।
কিন্তু আশেপাশে মানুষ রয়েছে যে, তারা বলবে কী? মাথা হেঁট করে পার্ক থেকে বেরিয়ে আসে বীথি।
এমনি করে মাসের পর মাস ভুগতে থাকে বীথি। আবুর জন্যে থেকে থেকে অস্থির হয়ে ওঠে তার আত্মা। উনখ, অসহনীয় মনে হয় শরীরের একেকটা স্নায়ু। কিন্তু কিছু করা যায় না যে। তার বদলে জোর করে বীথি পড়া নিয়ে, কলেজ নিয়ে ডুবে থাকতে চায় সারাক্ষণ। আর বাকি সময়টুকু নিজেকে ব্যস্ত রাখে রান্নাঘরে, সংসারের কাজে।
ভেতরটা তো জানা যাচ্ছে না, মরিয়ম চোখে যা দেখলেন বড়ড বিব্রত বোধ করলেন। পরের মেয়ে পড়তে এসেছে, কদিনইবা থাকবে, তাকে ঘরের কাজ রোজ রোজ করতে দেখলে লোকে বলবে কী? একদিন তাকে বলতে শোনা গেল, বীথি, আবার তুই ঝাড় হাতে নিয়েছিস? তোকে কতবার মানা করবো বলতো।
বীথি হেসে বলে, চাচিমা, তুমি রান্না করছ। ঘরটা আমি সামলালে কী হয়? সারাদিন তুমি একা সব করবে, সে হবে না।
তার জন্যে বীথির মমতা দেখে মনে মনে খুশি হন মরিয়ম। কিন্তু বাইরে জানান দেন না। কপট আহত কণ্ঠে বলেন, যা খুশি করগে বাপু।
রান্নাঘর থেকে সন্ধ্যের আগে তিনি বেরিয়ে দেখেন, বীথি যে শুধু ঘরটাই ঝাঁট দিয়ে রেখেছে তা নয়, তার জন্যে জায়নামাজটা পর্যন্ত বিছিয়ে রেখেছে। আর বারান্দায় পরিষ্কার করে মাজা এনামেলের বদনায় ওজুর পানি। মরিয়মের মন তখন ভীষণ প্রসন্ন হয়ে ওঠে। নামাজ পড়ে উঠে বীথির ঘরে এসে কথা বলার ছলে তার সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দোয়া মাখিয়ে দেন। বীথি সেটা বুঝতে পারে। অনেকক্ষণ তার মন নির্মল হয়ে থাকে। মনে হতে থাকে, কই তার কষ্ট?
হাশেমের কাছে লেখা বকুলের চিঠিগুলো পড়ে অবধি নিজেকে বোঝা যেন অনেক সহজ হয়ে যায় বীথির। মনের ভেতরে যা হয়, এতকাল তা যেন বোঝা যেত না, কথা দিয়ে ধরা যেত না। এখন ভাষা খুঁজে পাওয়া গেছে বকুলের চিঠি থেকে।
কষ্ট, আত্মা, সৌন্দর্য এই কথাগুলোর অর্থ যে নতুন ব্যঞ্জনায় কত অপরূপ হয়ে উঠতে পাবে, এই একেকটা ছোট্ট শব্দ যে কত বিরাট অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারে, তা জেনে অবধি বীথির অন্তরটা মুখর হয়ে আছে। কথা বলতে ইচ্ছে করে আবুর সংগে।
কিন্তু বলা হয় না। ভেতর থেকে কিসের সংকোচ বোবা করে রাখে তাকে।
আবুকে সামনে পেলে মুখ অন্ধকার করে থাকা, তার কথার জবাব না দেয়া, জবাব দিলেও ইচ্ছে করে দুঃখ দেয়ার স্বভাবগুলো যেন তাকে পেয়ে বসেছে।
কিন্তু হৃদয়ের এই বিশাল তরংগকে সে ঠেকিয়ে রাখবে কী করে? বেঁধে রাখতে গিয়ে তার দোলা আরো প্রচণ্ড হয়ে ওঠে। তার দুর্বার ধাক্কায় একেকদিন বীথি এই বাস্তব পৃথিবীর কুল থেকে অন্য অজানায় আছাড় খেয়ে পড়ে চেতনার প্রদোষ–প্রতিম আলোয়।
একদিন হয়েছিল এমনি। সে রাতের কথা আজো স্পষ্ট মনে আছে বীথির। আৰু এসে তার বারান্দায় পায়চারি করছিল। শুয়ে শুয়ে টের পায় বীথি। সমস্ত অনুভূতি আর ইন্দ্রিয় সুচীমুখ হয়ে ওঠে। মাথার ভেতরে যন্ত্রণা হতে থাকে। বাইরে অবিরাম শোনা যাচ্ছে তার পায়ে পায়ে চলার শব্দ। বীথির আত্মা যেন সমুদ্রের মতো আছড়ে উঠতে চায়। বলতে চায়, কেন তুমি এলে আবু ভাই? আবু দরোজার কাছে মুখ রেখে বলে, বীথি, আয়।
না।
আয় নারে।
ডাকটায় কী ছিল, বীথি উঠে আসে তখন।
আবুর শাদা পাজামা অন্ধকারে একটা পতাকার মতো কাঁপতে থাকে বাতাসে। তার শরীরটাকে কী দীপ্তিময় মনে হয়। মনে হয়, আবু তার ভাবনা থেকে জন্ম নিয়ে আজ এই রাতে অশান্ত হয়ে বীথির দরোজায় এসে দাঁড়িয়েছে। আবুকে সে একটা সৌরভের মতো মেখে নিতে পারবে যেন, এত অবাস্তব অশরীর মনে হয় তার উপস্থিতি।
তার মতো আবুরও কি কষ্ট হচ্ছে আজ?
আবু ওর হাত ধরে বলে, কেমন বাতাস দিয়েছে দেখেছিস, বীথি? বাগানে গিয়ে বসবি একটু? ভয় নেইরে, আমি তোকে আর জ্বালাবো না।