সন্ধ্যের পর আবু বলল, চল, কোথাও গিয়ে বসিগে।
না, না।
বীথির ভয় করে। আবু পরামর্শ দেয়, তাহলে হাঁটি কিছুক্ষণ?
হাঁটতে হাঁটতে রেসকোর্সের কাছে এসে পড়ে ওরা। পথ ছেড়ে পাড়ি দিতে থাকে বিশাল ময়দান। আবু বলে, তুই খুব একা, নারে বীথি? সারাদিন বই আর কলেজ। একেক সময় আমার খুব রাগ হয় তোর ওপর।
বারে, পড়াশোনা করব না?
করবি তো। তাই বলে অন্ধ হয়ে থাকবি?
বীথি বুঝতেই পারে না আবুর আজ কী হয়েছে। তাকে একেবারে অন্যমানুষ মনে হচ্ছে। অন্ধ হয়ে থাকার অর্থটাও কিছুতেই বোধগম্য হয় না। সেটা টের পেয়েই আবু যেন খেদ করে বলতে থাকে, মানুষ তো অন্ধই। অন্ধ নইলে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হয়? বলতে হয়, এইতো এখানে। কিরে, চুপ করে আছিস যে? তোর খারাপ লাগছে?
নাতো।
তবে?
আমি কী বলব?
আবু যেন আপন মনেই আবর্তের মতো ঘুরতে থাকে। প্রথমে একটু চটে যায়। বলে, তোকে কিছু বলতে বলেছি নাকি?
পরে মমতায় ভিজিয়ে আনে কণ্ঠ।
—-হারে, এত যে বকছি, তুই রাগ করছিস না? তোকে যেন মানাচ্ছে না মোটে। তুই আমাকে চটে উঠছিস না কেন? আমার বিচ্ছিরি লাগছে।
বীথি মৃদু গলায় বলে, আমি রাগ করতে জানি না।
ঐটুকু বলতে গিয়েই যেন হাঁপ ধরে যায়। গা কেঁপে ওঠে। আবু ওর হাতটাকে অন্যমনস্কভাবে মুঠোর ভেতরে নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছে। যেন খুব তন্ময় হয়ে কী ভাবছে।
অনেকক্ষণ পরে সে বলে, পৃথিবীতে বেঁচে থাকার অনেক কষ্ট, বীথি। তুই যা ভালো বুঝবি, করতে পারবি নে। বাইরে থেকে যে কেউ বাধা দেয়, তাও না। মনে হয়, মানুষগুলো সব নিজের শক্র। জানিস বীথি, তোকে দেখে যেন বুঝতে পারি আমি বেঁচে আছি।
বীথির মনে ছোটখাটো একটা ঝড় ওঠে। আবুর জন্যে কেমন বেপরোয়া টান পড়ে বুকের ভেতরে। বলে, বাসায় চলো।
তোর খারাপ লাগছে?
বীথি উত্তর দেয় না। আবু হেসে বলে, জানি তুই রাগ করেছিস। তোকে এসব কথা বলতে গেলাম কেন? কী জানি কেন বললাম। আমাকে খুব অমানুষ অভদ্র বলে মনে হচ্ছে তোর, না?
বীথি বলতে চায়, নাতো। কিন্তু পারে না। কিছুক্ষণ চুপচাপ হাঁটবার পর আবু যেন হঠাৎ রুখে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে বলে, তাহলে তুই আমার সামনে এসে দাঁড়ালি কেন, বীথি? আমাকেও কি পাগল বানিয়ে ঘর ছাড়া করতে চাস?
কী বলছ, আবু ভাই!
বীথি আর্তনাদ করে ওঠে।
ঠিকই বলছি। আমি তোর কাছে হাত পেতে দাঁড়িয়েছি, না দাঁড়াব যে তুই অমন রানীর মতো মুখ বুজে থাকবি?
তুমি ঘর ছাড়বে কেন?
কী জানি! বড়চাচা বলেন, হাশেম ভাই সাধু হয়ে গেছে। আসল ব্যাপারটা তো জানি আমি। বীথির কৌতূহল হয়। এসে অবধি সে হাশেমের বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথাই শুনছে। কেন গেছে, ভালো করে কেউ তাকে বলতে পারেনি। বীথি সব ভুলে গিয়ে শুধোয়, কী হয়েছিল?
আবু মুখ ফিরিয়ে বলে, কাউকে বলিস না যেন। হাশেম ভাই ভালোবাসতো। ভালোবেসে। ঘর ছেড়েছে। তোর বিশ্বাস হয় না?
বুকের ভেতরটা বরফ হয়ে যায় বীথির। আবু বলে, এক একজন অমন করেই ভালবাসে, বীথি। কোন বাধ মানে না, যুক্তি বোঝে না। পাথরের সংগে আত্মার বিয়ে দিয়ে দেয় ওরা।
—-নে, একটা রিকশ ডাকি। বাড়ি চল।
সেদিন বাড়ি ফিরে এসেই মরিয়মের সমুখে পড়ে গেল ওরা দুজন। আবু চলে গেল ভেতরে। মরিয়ম জিগ্যেস করলেন স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বীথিকে, কোথায় গিছলি?
একমুহূর্ত ভাবলো মেয়েটা। বলল, বড় চাচার বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখি আবু ভাই। তার কথা শুনে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে অবাক হলো আবু।
আরেকটা দিনের কথা মনে করতে পারে বীথি।
আবু ইউনিভার্সিটি যাবার আগে গোসল করে তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে তার দরোজায় দাঁড়িয়ে বলল, কী করছিস?
কিছু না।
তোর চিরুণিটা দে, সিথি করি। ইস, চুলগুলো যা বেয়াড়া লম্বা হয়েছে।
বীথি চিরুণি দিয়ে বলে, সেলুনে গেলেই পারো। ভীষণ আলসে আর নোংরা হয়েছ তুমি। আবু সিথি করতে করতে উত্তর দেয়, তাই বুঝি রোজ আমার ঘর সাজিয়ে রাখিস তুই?
রাখতো বীথি। কিন্তু মিথ্যে করে বলল, বয়ে গেছে। চাচিমা করেন।
আমার কি চোখ নেই?
আবু হাসতে হাসতে বলেছিল কথাটা। কিন্তু কতখানি যে মোচড় তুলল বীথির বুকে তা যদি আবু জানতো!
আবু চিরুণি রেখে বলল, কাল বিকেলে মনে হলো তুই যেন আমার ঘরে এলি। আমি বার থেকে ফিরে এসে শুয়েছিলাম। তুই টের পেলি কী করে যে ঘুমোচ্ছি? আমার মুখ দেখছিলি কেন? কী চুরি করতে এসেছিলি? আমি যদি তখন খপ করে তোর হাত ধরে ফেলতাম। তোমার কি বুদ্ধি লোপ পেল, আবু ভাই?
কী জানি।
ঘরে ফিরে এসে ঘুমোচ্ছিল আবু। বিকেল ছটা ঘুমোনোর সময় নয়। বীথি তাকে শুয়ে থাকতে দেখে চমকে উঠেছিল। বুঝি অসুখ করেছে। পা টিপে ঘরে এসে আবুর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। কিছু ঠাওর করতে না পেরে কপালে হাত রেখেছিল। আবু যদি তার তাকিয়ে থাকা টের পেয়ে থাকে তো কপালে হাত রাখার কথা বললো না কেন?
আবু বলল, আমার ঘরে অমন করে আসিস না। শুধু শুধু কষ্ট পাবি। কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কী? আবু চলে যায়। দোটানায় পড়ে বীথি আছাড় খেতে থাকে কেবলি। এই যদি বলবে তো আবু অমন করে তাকে নিয়ে কেন একেকদিন মেতে ওঠে? বীথি বুঝতে পারে না। কান্না পেতে থাকে। আবুর ওপরে চটে যায়। তখন পেন্সিল আঙুলের মধ্যে বুনে ব্যথা সৃষ্টি করতে থাকে বীথি।