ভেতর থেকে কথাটা শুনতে পেয়েছিলেন মরিয়ম। মাথায় ঘোমটা তুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তাঁকে দেখে চোখ নত করলেন খোরশেদ চৌধুরী।
.
সন্ধ্যার অন্ধকারে বাগানে নির্মম হাতে ফুল ছিড়ছিল বীথি। বাসার বাঁ পাশে অনেকদিন থেকে অনেকটা খালি জায়গা পড়ে ছিল। আবু সেখানে বাগান করেছে। এক কোণে দুটো বুড়ো বাতাবি নেবুর গাছ। তারপরেই দেয়াল। ওপারে রাস্তা। বীথির পরনে ছিল তাঁতের গাঢ় সবুজ শাড়ি। অন্ধকারে দূর থেকে ভালো করে ঠাওর হয় না। থোকা থোকা অন্ধকারের ভেতর থেকে শাদা শাদা ফুল আর কিসের তন্দ্রা–সৌরভ যেন জ্যোতি হয় বেরুচ্ছে। চারদিকের ব্যস্ততা আর কোলাহল যেন দেয়ালের ওপারে ঠেকিয়ে রেখেছে এক মায়াবিনী হাত। আবু তাকে ওপরতলা নিচতলা খুঁজে খুঁজে হয়রান হলো।
মাকে জিগ্যেস করল, মা বীথি কই?
মরিয়ম বিরক্ত হলেন।
এই সন্ধ্যেয় বীথি বীথি করে চাঁচাস নে তো।
নামাজ পড়ে রান্না ঘরে যাচ্ছিলেন তিনি, তার পথ থেকে সরে দাঁড়িয়ে আবু বলল, ছেলে ফিরে এসে দেখি তোমার মেজাজটাই বদলে গেছে।
আজ মায়ের অপ্রসন্ন মুখ দেখে আবুর বিস্ময় যেন বাধ মানছিল না। মরিয়ম বললেন, মাতামাতি করিস বলেই তো মেজাজ করতে হয়।
কেন? আজ নতুন নাকি?
নতুন না হলেও বীথি বড় হয়েছে।
কোনোদিন যে ছেলের ওপর রাগ করেননি তাকে বকতে গিয়ে চোখে পানি এসে যায়। তার ওপর ভরসন্ধ্যে। বুক কাঁপতে থাকে মরিয়মের। কিছু না বলে অশ্রু চেপে চলে যান। বোকার মত অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে আবু।
অবশেষে বীথিকে পাওয়া গেল বাগানে। সে তখন বেলি গাছটার সর্বনাশ করেছে সবকটা ফুল ছিঁড়ে। একটা ডাল করুণ হয়ে কাঁপছে তার হাতের মুঠোয়। আবু তার পেছনে দাঁড়িয়ে চুপ করে রইলো খানিক। বীথিকে ডাকতে গিয়ে কেমন সংকোচ হচ্ছে তার এই প্রথম। আর বুঝতে পারছে না বীথির কাছে গাছটা কী অপরাধ করেছিল। ইতস্তত করে সে অস্ফুট কণ্ঠে ডাকল, শোন।
শুনল, বীথিমুখ ফেরাল না। তার শরীরে একটা অস্পস্ট সাড়া জাগল শুধু। হাতের ডালটা ছাড়া পেয়ে লাফিয়ে ফিরে গেল। আবু জিগ্যেস করল, এখানে কী করছিস?
বীথি জবাব দিল না।
পায়ের কাছে ফুলের শাদা শাদা অংশ ছড়িয়ে আছে। বেলি গাছটা আবুর খুব প্রিয়। কিন্তু আবু কণ্ঠ নামিয়ে মমতা করে বলল, অমন করে সব ছিড়লি কেন? আমি তোকে সারাটা বাড়ি খুঁজে খুঁজে পাচ্ছি না। কিরে?
হঠাৎ আবুর মনে হলো তার সামনে বীথির বদলে বিলকিস পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। বীথিকে খুঁজতে এসে যেন বিলকিসকে আবিষ্কার করে ফেলেছে সে তার বাগানে। বলল, বুঝতে পারছি আজ তোরও মেজাজ হয়েছে।
মোটেও না।
এই এতক্ষণ পর একটা কথা উচ্চারণ করল বীথি। তারপর সরে এসে সিঁড়ির একটা ধাপে বসে রইলো।
তখন আবু এসে তার নিচের ধাপে বসলো। তার দিকে তাকালো না। জিগ্যেস করল, হাশেম ভাইকে দেখলি?
হ্যাঁ।
আমাকে দেখে বুঝলি, বীথি, আমার চোখের দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে রইলো।
বীথির দিকে তাকালো আবু। কেঁপে উঠলো বীথির বুক।
ও–কী, কথা বলছিস না যে? কথা বলবি না তো মর।
তারপর অন্যদিকে তাকিয়ে, যেন বীথিকে সে মোটেই উদ্দেশ করছে না, এমনি করে বলে, মা–ও খুব মেজাজ দেখালেন আজ। সারা বাড়িটার যে কী হয়েছে তোরাই বুঝিস। তুই আমার শত্রু, বুঝলি?
বীথি চমকে চোখ ফিরিয়ে বলল, কেন, চাচিমা কী বলেছেন?
কিছু না। তুই শুনে কী করবি?
আবু আর বসে থাকতে পারল না। চলে যাবার জন্যে উঠে দাঁড়াল। আবার তক্ষুনি চলে না গিয়ে বলল, আচ্ছা, আমাকে সত্যি করে বলতো কী হয়েছে?
বীথি বুঝতে পারে না, ভয় হয়, আবু বুঝি তার অন্তর পড়ে ফেলেছে। নিজেকে তাই পাথর করে রাখে সে। কী একটা বলতে গিয়ে বলতে পারে না। কোনোরকমে পায়ের কড়ে আঙুলে সিঁড়ির একটা ভাঙ্গা কোণ আঁকড়ে ধরে বসে থাকে। আবু বলে, বুঝতে পেরেছি, আজ তুই আমাকে পড়তে দিবিনে, খেতে দিবিনে, এমনি করে জ্বালিয়ে মারবি তুই।
মানুষের একেক সময় কী হয়, শখের পুতুল নিজের হাতে আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেলে। কণ্ঠে তিক্ততা এনে বীথি বলে, কেন, আমি তোমার কী করেছি?
কী করিসনি বল?
আবু আবার সিঁড়ির ধাপে বসে। বসে যোগ করে, তুই কি মনে করেছিস, অমন মেজাজ করে থাকলে আমি আজ খেতে পারব? না, দুদণ্ড বই খুলে বসতে পারবো?
বীথি হঠাৎ পরিপূর্ণ চোখ তুলে তাকাল আবুর দিকে। আত্মার ভেতরে চুর চুর হয়ে যেতে যেতে সে উচ্চারণ করল, আমাকে তুমি কেন জ্বালাতে আসো, আবু ভাই?
.
বুকের ভেতরটা জ্বলতে থাকে বীথির। বাতি নিবিয়ে চুপচাপ অন্ধকারে শুয়ে থাকে। মনে মনে একা হয়ে যায় সবার কাছ থেকে। মাথার ভেতরে ফিরে আসে আবার সেই ভাবনা হাশেম ভাই কী করে জানলেন, আমি কষ্ট পাই? যেন কষ্টটার কথা কেউ বলে দেয়াতেই কষ্টের মাত্রা গেছে বেড়ে। একদিন, অনেকদিন আগে আবু তাকে বলেছিল, বীথি, আমার সংগে বেরুবি?
বীথি থাকত চুপচাপ। বড় একটা কারো সামনে বেরুতো না, কোথাও যেত না। সে যে এ বাড়িরই একজন একেক সময় যেন টের পাওয়া যেত না তাও। আর আবুর সংগে তার কথা হতো একেবারেই কম। সেদিন আবুর এ প্রস্তাব শুনে সে থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণে আবছা খুশি লাগে। বেরিয়েছিল আবুর সংগে। আবুর যেন ঘোর লেগেছিল সেদিন। পকেটে যা পয়সা ছিল সব খরচ করেছে রিকশয় রেস্তোরাঁয় বীথিকে নিয়ে। হাতে যা সময় ছিল সব। উড়িয়ে দিয়েছে অস্থির হয়ে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় গিয়ে। কোনখানেই দুদণ্ডের বেশি তার মন টেকেনি। বিকেল থেকে শুরু করে সন্ধ্যের সেই অনেক পর অবধি এই কাণ্ড। বীথির যে কী নামহীন আনন্দ হচ্ছিল সেদিন। কিন্তু বাইরে তার কোন জানান দেয়নি। লজ্জা করেছে। বুকের ভেতর তরংগ উঠেছে।