খোরশেদ চৌধুরী মুখ ফিরিয়ে ভাইকে বললেন, দেখেছ মুরশেদ, এখনো আমার কথা ভোলেননি। পাগল হলে কী হবে, ঠিক মনে আছে।
তারপর হাশেমকে দেখিয়ে মরিয়মকে বললেন, ছোটবেলায় পুরো একটা বছর আমার কাছে। ছিল যে। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমোত! এই ছোট্ট এতটুকুন। শোধও ছিল না, বোধও ছিল না। তারপরে–না এলো মুরশেদ রেঙ্গুন থেকে।
হাশেম হবার পরপরই চাকুরি সূত্রে মুরশেদ চৌধুরী এক বছরের জন্যে রেঙ্গুন গিয়েছিলেন। এক বাসাতেই থাকতেন তখন তিন ভাই। খোরশেদ চৌধুরী তখন, এখনো নিঃসন্তান। হাশেমকে সেই একটা বছর বুকে করে রাখার স্মৃতি তিনি ভুলতে পারেন নি। খোরশেদ চৌধুরীর চোখ সজল হয়ে উঠতে চায় যেন। বিব্রত হয়ে শাদা চুলের ভেতরে হাত চালাতে থাকেন খামোকা। মরিয়মকে বলেন, তোমার ভাগ্য ভালো এমন ছেলে কোলে পেয়েছিলে। কে বলল ও পাগল হয়েছে? আমি পাগল চিনি না? যেমন ছেলে তেমনি আছে।
হঠাৎ হাশেম চোখ খুলে বলল, পানি।
তাড়াতাড়ি গেলাশ ভরে পানি এনে দেন মরিয়ম। হাশেম ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে বিছানা থেকে আবার নেমে যেতে চায়।
খোরশেদ চৌধুরী বুক দিয়ে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।
না, না, কী কচ্ছিস?
আহ।
যেন অসীম বিরক্ত হয়েছে হাশেম বাধা পেয়ে।
ছেড়ে দিন আমাকে। আজ আমার খুব অস্থির লাগছে যে। খালি হাঁটতে ইচ্ছে করছে। কথা বলতে ইচ্ছে করছে। বলুন, কথা বলুন।
বড় চাচার হাত ধরে বিষম ঝাঁকুনি দেয় হাশেম। তারপর উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে থাকে। বলে, ভয় হয়, এই বুঝি সব শেষ হয়ে গেল। কিন্তু
জানালার কাছে গিয়ে হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল হাশেম। মাথা নত করে কী যেন ভাবল। কিসসু বুঝতে পারেন না মুরশেদ চৌধুরী। বাড়ির বড় ছেলে অমন করে চলে যাওয়াতে আঘাত তিনি কম পান নি। এবার ছেলেটাকে সুস্থ মানুষের মতো দাঁড়াতে দেখে গলা খাকারি দিয়ে শুধোলেন, এতকাল ছিলি কোথায়, হাশেম?
স্বামীর প্রশ্নে মরিয়মও এগিয়ে আসেন। কাছে এসে তিনিও জিগ্যেস করেন, হ্যাঁরে, হঠাৎ চলে গেলি, একবার বাপ–মার কথা মনে পড়ল না? চলে গেলি কেন, হাশেম? কী তোকে দিতে পারিনি, বলবি না? তোর বাবার কান্না শুনে পথের মানুষ দাঁড়িয়ে পড়ত, আর তোর কানে গিয়ে পৌঁছোয় নি?
খোরশেদ চৌধুরী ছোট্ট একটা ধমক দিয়ে ওঠেন, এ সব কথা এখন থাক।
হাশেম আবার পায়চারি করতে শুরু করল। তারপর ধপ করে একটা চেয়ারে বসে, বুকের কাছে দুপা টেনে নিয়ে একটা বাঁধা কবুতরের মতো ম্লান হয়ে রইল। বলল, কম্বলটা দাও।
কম্বলটা হাতে পেয়ে ভালো করে গায়ে জড়াতে জড়াতে অপরূপ পরিতৃপ্ত দেখালো তাকে। বলল, একবার এক গাঁয়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছিলাম। পথে দাঁড়িয়ে দেখলাম, বিরাট এক পুকুর। সেই এ মাথা থেকে ও মাথা। শান বাঁধানো ঘাট। ঘাটে দাঁড়িয়ে শত শত মানুষ পাগলের মতো পানি তুলে ফেলছে।
তার কথা শুনে ঘরের ভেতরে সবাই চুপ হয়ে গেছে। হাশেমের কণ্ঠ যেন কোন এক সুদূরের দেশ থেকে ভেসে আসছে। এই যে ছেলেটা, যাকে তারা দেখেছেন জন্ম থেকে, তার ভেতরে আজ সম্পূর্ণ অজানা এক পৃথিবীর অস্তিত্ব টের পেয়ে বড় চাচা, মা, সবাই বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছেন। যেন তাদের নতুন চোখ খুলে যাচ্ছে। হাশেম বলে চলেছে, আমি দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করলাম, হ্যাঁগো ভাল মানুষ, এখানে আজ কিসের উদ্যোগ? একটা লোক, তামার মত তার। গায়ের বরণ, খালি গা, মাথায় লাল গামছা বাধা। সে বলল, খাঁ সাহেবের হুকুম হয়েছে পুকুর থেকে তামাম পানি তুলে ফেলতে হবে। আমি শুধোলাম, কেন? তখন আরেকটা লোক জবাব করলো, এ পুকুর যে ফি বছর মানুষ খায়। সাঁতার দিয়ে মাঝপুকুরে গেলে আর ফিরে। আসে না, তাই এবার খা সাহেবের হুকুম হয়েছে পুকুর থেকে পানি তুলে দেখবেন তলায় কী আছে? হাশেম মৃদু হাসলো এইখানে থেমে। কাণ্ড দ্যাখো। মানুষটা কী ক্ষ্যাপা। বলে কী না, পুকুর শুকিয়ে দেখবে কোন রাক্ষস হাঁ মেলে আছে তার পাতালে। সেদিন সারাটা দিন দাঁড়িয়ে ছিলাম কাঠফাটা রোদ্দুরে। চারধারের ফেটে যাওয়া মাঠে নহর বইলো। তবু যদি এক আঙ্গুল পানি কমলো পুকুরের। যত তুলে ফেলছে, কল কল কল কল করে পানি তত বাড়ছেই। আমার মনে হচ্ছিল যেন আমার রক্ত ওরা নিঙড়ে নিঙড়ে ছেঁকে তুলছে।
বলতে বলতে ঘুমিয়ে পড়ে হাশেম। প্রথমে মনে হয়, চোখ বুজে ভাবছে, দৃশ্যটা প্রত্যক্ষ করছে। কিন্তু না, ঘুম এসেছে তার। একটানা কথা বলতে বলতে অবশ হয়ে গেছে স্নায়ু। তাকে তুলে এনে শুইয়ে দেয়া হলো বিছানায়। মরিয়ম গিয়ে বসলেন তার শিয়রে।
বারান্দায় এসে খোরশেদ চৌধুরী ভাইকে বললেন, হ্যাঁ ভালো কথা মুরশেদ, গেল কাল। ছোটমিয়া চিঠি লিখেছে বীথির ব্যাপারে। তোমাকে একটা কথা বলা দরকার।
খোরশেদ চৌধুরীকে তখন বড় বিব্রত দেখাচ্ছিল। কাল চিঠি পেয়ে অবধি মনে স্বস্তি পাচ্ছেন না, বুঝতেও পারছেন না কী করে কথাটা পড়বেন। মুরশেদ চৌধুরী উদ্বিগ্ন হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন। বীথির নাম শুনে বুঝতেই পারলেন না তার আবার কি হতে পারে। বিহ্বল হয়ে বললেন, বীথি, বীথির কী?
কিছু না।
খোরশেদ চৌধুরী ভাইকে ভরসা দেয়ার মত করে হাসেন। আমতা আমতা করে বলেন, ইয়ে, লিখেছে যে, আবুর সংগে বীথির মেলামেশাটা কেমন যেন দেখাচ্ছে। মানে, তুমি বীথিকে আমার ওখানে পাঠিয়ে দাও না?