ফাৎনার দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে কেমন সব ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সালু আপা ভারী আড্ডাবাজ হয়েছে। খালি ক্যারম খেলবে বুলু ভাইদের বাসায় গিয়ে। বাবার মুখ মনে পড়ে যায় আনুর। বাবাকে গিয়ে এবার বলবে। সেজ আপাকে বলবে, একটা দরখাস্ত করে দিতে ফুল ফ্রি–র জন্যে। ফুল ফ্রি হয়ে গেলে আবার মিনু আপা সালু আপা স্কুলে যেতে পারবে। ওদের জামাগুলো পুরনো হয়ে গেছে, ছিঁড়ে গেছে। একটা পাখি না পোকা কোথা থেকে তখন থেকে কিট কিট করে ডাকছে।
এইসব মুহূর্তে আনু একেবারে একা হয়ে যায়। চারদিকে কেউ নেই, কোথা থেকে বিচিত্র সব শব্দ উঠছে, ফাৎনাটা স্থির হয়ে আছে। মনে হয় আনুর ঘর নেই, বাড়ি নেই, ক্ষুধা নেই, তৃষ্ণা নেই, তার কেউ নেই। সে কোনদিন বড় হবে না, মহিমপুর ছেড়ে কোথাও যাবে না। মনে হয় সব স্থির হয়ে গেছে।
একটা ঢিল এসে লাগে তার পিঠে। চমকে ওঠে আনু। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে চারদিকে তাকায়। কি ব্যাপার? গীর্জা ঘর, স্কুল, জিনি সিস্টারের কোয়ার্টার সব দেখা যাচ্ছে দূরে, সেখানে কেউ নেই। আশেপাশে একেবারে ফাঁকা। গাছের ওপরেও কিছু চোখে পড়ল না আনুর। তাহলে তাকে ঢিল ছুঁড়ে মারলো কে?
কিসসু বুঝতে না পেরে বোকা হয়ে গেল আনু। তারপর আবার বসলো ছিপ নিয়ে। কিন্তু মনটা তার খুঁতখুঁত করতে লাগলো। এ সব নির্জন জায়গায় কত রকম কী আছে! আনু শুনেছিল, অনেকদিন আগে এক পাদ্রী আত্মহত্যা করেছিল। জোছনা রাতে তাকে নাকি এখনো দেখা যায় গীর্জা–ঘরে হাঁটতে, পুকুর পাড়ে বসে থাকতে, আবার তকতকে উঠোনে নাকি মাঝখানে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আনুর সঙ্গে একটা খ্রিষ্টান ছেলে পড়ত পিটার পল দাস। সেই পিটার বলেছে, তার বাবা নাকি নিজের চোখে দেখেছে।
আনুর গা ছমছম করে ওঠে। কি জানি, সেই পাদ্রী ভূতটা না তো! এখন আরেকটা ঢিল এসে পায়ের কাছে লাগে। চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে, পিন্টু : ফিচ ফিচ করে হাসছে বুড়ো জারুল গাছটার আড়ালে দাঁড়িয়ে। আনু অবাক হয়ে গেল। পিন্টু। গলা তুলে ডাকতে সাহস পেল না, পাছে গীর্জার লোকেরা টের পেয়ে যায়। এমনিতে সে চুরি করে মাছ ধরতে বসেছে। জিনি সিস্টার ভারী কড়া। ধরতে পারলে শাস্তি দেবেন। আনু তাই নিঃশব্দে ক্রুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো পিন্টুর দিকে। সে এখন এক পা এক পা করে কাছে এগিয়ে এলো।
মাছ ধরছিস?
আনু জবাব দেয় না। পিন্টু আবার বলে, এঃ, একটাও ধরতে পারিস নি।
আনু ফাৎনার দিকে তাকিয়ে থাকে। পিন্টুর সাথে তার সেই প্রথম দিনের ঝগড়ার পর মুখে ভাব হয়ে গেলেও মনে মনে কিছুতেই আনু ওকে ভালো চোখে দেখতে পারে নি। সারাক্ষণ এমন সব বিচ্ছিরি কথা বলতে থাকে আর ইশারা করে যে আনুর চোখ কান লাল হয়ে যায়। পিন্টু এখন বলে, বলে দেব তুই মাছ ধরছিস?
যা বলগে। বল না?
পিন্টু কী ভাবে। তার গা ঘেঁসে বসে আরো। খুব উদার একটা ভঙ্গিতে ঘাটে কাৎ হয়ে শুয়ে বলে, যা, বলবো না।
হাতটা আলগোছে ধরে পিন্টু। আনু ছাড়িয়ে নেয়। ফাটা বুঝি নড়ে ওঠে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলে আনু দূর, কিছু না। আজ আনুর বরাতটাই খারাপ। বাজে কথা বলেছে। ফাঁকি দিয়েছে। তারচেয়ে টোগরাই হাট পুলের নিচে গিয়ে বসলে ঢের মাছ ধরতে পারত আনু। পিন্টু পকেট থেকে সিগারেট বার করে, আর দেশলাই। আনু অবাক হয়ে জিগ্যেস করে, তুই সিগ্রেট খাস?
এবারে পিন্টু চুপ করে থাকে। ঠোঁটের ফাঁকে তেরছা হাসি ফুটিয়ে সিগারেটটা নেড়ে দেখে। তারপর পুরো চিৎ হয়ে শুয়ে ঠোঁটে গুঁজে দেয়। দেশলাই জ্বালায়। একমুখ ধোঁয়ার আড়ালে পিন্টুর মুখ ঢেকে যায়। কেমন অদ্ভুত দেখায়। গা শিরশির করে ওঠে আনুর। পিন্টু বলে, খাই তো। সিগারেট না টানলে কেউ বড় হয় না।
তোর বাবা কিছু বলে না?
বাবা জানেই না। চালের বাতায় খুঁজে রাখি, ভাত খেয়ে পায়খানায় বসে খাই। জানবে কি করে? বুদ্ধি থাকা চাই।
তখন ভীষণ ভয় করে আনুর। এখন যদি কেউ দেখে ফেলে। তাহলে সবাই ভাববে, আনুও সিগারেট খায়। সে অস্বস্তি বোধ করতে থাকে। পিন্টু কোথা থেকে এলো শয়তানের মতো? যায়ও না ছেলেটা। আনু ছিপ তুলে নেয়, গুটিয়ে ফেলে সব। পিন্টু খপ করে তার হাত ধরে ফেলে।
কোথায় যাচ্ছিস?
হাত ছাড়।
আগে বল, কোথায় যাচ্ছিস?
বাসায়।
একটু বোস না ভাই।
পিন্টু হঠাৎ নরোম গলায় বলে উঠে বসে। আনু কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে বসে। বলে, তাহলে তুই সিগারেট খেতে পারবি না।
দূর, ভয় কিরে? এখানে কে দেখছে?
না দেখুক। আমার ভালো লাগে না।
তুই খাবি একটা?
ফস্ করে পকেট থেকে সিগারেট বার করে পিন্টু। কিছু বলার আগেই আনুর হাতে খুঁজে দেয়।
খা না। কে দেখবে?
না, কক্ষনো না।
তুই গাধা। খেলে বুঝতি কী মজা। খা না। দ্যাখ, এইরকম করে টান দিবি, কিছু লাগবে না। বলতে বলতে পিন্টু টান দিয়ে দেখায়। তারপর নাক দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে। তুই কিন্তু প্রথমে নাক দিয়ে আমার মতো ছাড়তে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবি। প্রথমে গিলবি না। টানবি আর ধোঁয়া ছাড়বি। ধর।
এক ধাক্কা দিয়ে তার হাত সরিয়ে দেয় আনু। হাতটা শানের ওপর গিয়ে পড়ে। ব্যথা লাগে পিন্টুর। লাফ দিয়ে সে উঠে দাঁড়ায়। চিৎকার করে বলে, এঃ সাধু মহারাজ। ঘুসখোরের ব্যাটা, তার ফুটানি কত!