বাবা তাকে ডেকে নিলেন।
চলতো, বাজার থেকে আসি। থলেটা নিয়ে আয়।
বাবা বাসার সামনে খুব আস্তে আস্তে পায়চারি করছেন আর কথা বলছেন বড় জমাদার সাহেবের সঙ্গে।
বাজারে গিয়ে দেখে সবে বাজার বসেছে। বড় বড় মাছ ধপাস ধপাস করে এনে ফেলছে শান বাঁধানো চত্বরের ওপর। ওপাশে বুড়ো বেহারি খাসির রানগুলো ঝুলিয়ে রাখছে। বাজারের পেছনে মজা পুকুরটা কচুরি পানায় সবুজ হয়ে আছে।
কিরে, মাছ নিবি না মাংস?
আনু কিছু বলে না। সে কী বলবে? বাবা তার উত্তরের অপেক্ষা না করেই মাছগুলার কাছে এগুলেন। বললেন, বীরেন, আজ একটা রুইয়ের মাথা দিতে হয়।
মাঝি হেসে বলে, কর্তা, আইজ কেনে তোমরা আইচ্চেন। মোক্ খবর দিলে, মুই দিয়া আনু হয়।
আচ্ছা, হয়েছে। বড় ছেলে বাড়ি এসেছে মাঝি। ভালো দেখে দিও। কেমন?
ঝপাং করে আনুর থলেতে আস্ত একটা প্রকাণ্ড রুইয়ের মাথা তুলে দেয় মাঝি। কাকো কি লাল! ফুলের মতো। টপটপ করে রক্ত পড়ছে। কিছুতেই দাম নেবে না সে। বাবা জোর করে দুটো টাকা গুঁজে দিলেন তার হাতে। তারপর ভালো শিলআলু নিলেন দুসের। নতুন টম্যাটো উঠেছে।
কত করে হে?
পাঁচসিকা সের।
পাঁচসিকে! —-আচ্ছা দাও, আধসের।
বাইরে বেরিয়ে আনুকে বললেন, ভাল লাগছে খুব?
নাহ্।
আনু একহাতে থলেটা ধরে জোরে জোরে হাঁটতে থাকে বাসার দিকে। ওজন ছিল সত্যি। কিন্তু ওজনটাকে কিছুই মনে হয় না তার। কদিন পরে রুইয়ের মুড়ো কিনলেন বাবা। স্বাদটা ভুলেই গিয়েছিল আনু। এত ভালো লাগে তার। রাতে কখন খেতে বসবে সেই ছবিটা আনুর জিভে সরস করে তোলে।
বাসায় এসে দেখে রান্নাঘরের বারান্দায় বসে পানু ভাই হাত নেড়ে নেড়ে গল্প বলছেন আর সিগারেট খাচ্ছেন। আপারা ঘন হয়ে বসেছে। মা বসে বসে সরু চাল বাছছেন। থলেটা বারান্দায় নামিয়ে দিয়ে আনু বলল, পানু ভাই! মার সামনে তুমি সিগারেট খাও?
হা-হা করে হেসে উঠলেন পানু ভাই। আপারা গড়িয়ে পড়ল এ ওর গায়ে। পানু ভাই তার পাছায় একটা চাপড় মেরে বললেন, মার সামনে খেলে কিছু হয় না। মা তো মা।
আনুও তখন হাসতে হাসতে তার হাঁটু ঘেঁষে বসলো। সে এখন ইস্টিশানের গল্প শুনবে। সবাইকে সে থামিয়ে দিয়ে পানু ভাইর হাত ধরে জিগ্যেস করে, তুমি ফোনে কথা বলো, না পানু ভাই? আর ঘটাং–ঘটাং করলে একটা বল বেরিয়ে আসে না?
.
নদী এইখানে বাঁক নিয়েছে। পানু ভাই মাঝিকে বললেন নৌকা বাঁধতে। ছিপগুলো ধরে ছিল আনু, সেগুলো নিলেন তিনি। বললেন, নেমে আয়। সাবধানে নামবি।
লাফ দিয়ে নৌকো থেকে নামলো তাবা। তারপর ফাঁকা ঝাউবনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগল। মহিমপুর থেকে কতদূর চলে এসেছে তারা। পানু ভাই মাছ ধরবে। মাথার ওপরে বেলা দুপুরের রোদ গনগন করছে। ধুধু নদী চর, প্রান্তর, পানি দেখাচ্ছে বিশাল একটা ছবির মতো। আবার পানিটা আয়নার মতো জ্বলছে, চোখ রাখা যায় না।
পানু ভাই চলছেন আগে আগে। তার কাঁধে ছিপ তিনটে। আর পেছনে আনু। তার হাতে ঝোলানো দুটো বার্লির কৌটা। ওর মধ্যে আধার আছে। আজ সারা সকাল ধরে মেথি হিং দিয়ে, বোলতার চাক ভেঙে, চাল ভেজে বানিয়েছেন পানু ভাই। মার কি বকা! পানুভাই শুনে হাসেন। মা খালি বলছিলেন, তুই কোথা থেকে শিখলি এসব? ভদ্দরলোকের ছেলেরা ধরে? যতো সব আলসে, অকম্মার বদনেশা। পানু ভাই একটুও প্রতিবাদ করেন নি। একমনে তিনি আধার বানিয়ে চলেছেন। বার আনুকে দিয়ে বাজার থেকে এক আনার পোনামাছ আনিয়েছিলেন, একটা কৌটোয় পানি দিয়ে পোনাগুলো তাজা করে রেখেছেন। আনু অবাক হয়ে গিয়েছিল, এই ছোট মাছগুলোকে বা মাছ খেতে আসে। মাছ, মাছ খায। কী অবাক কাণ্ড! আনুর খুব আসতে ইচ্ছে করছিল, মাছ ধরা দেখবে সে। কিন্তু বলতে সাহস হয়নি। পানু ভাই যেন মনের কথা পড়তে পারেন। আধার বানাতে বানাতে তিনি বলছিলেন, আজ তো তোর ছুটি, চল তুই আমার সঙ্গে।
ঈদের জন্যে বন্ধ দিয়েছে স্কুল।
ঝাউবনের ভেতর দিয়ে চারদিকে সন্ধানী চোখ ফেলে ফেলে হাঁটেন পানু ভাই। তারপর একটা জায়গা এসে বলে, খুব চিন্তিত আঃ আনমনা গলায়, এ জায়গাটা মন্দ না।
বলেই তিনি খাড়া পাড় বেয়ে নামতে থাকেন তরতর করে। আনুর খুব কষ্ট হয় নামতে। দুএকবার সে পড়ে যায়, গায়ে বালি লাগে, কিন্তু পানু ভাই ফিরেও তাকান না। একেবারে পানির কাছে এসে তিনি বলেন, বুঝলি, এইসব জায়গায় মাছ থাকে। নদী বাঁক নিয়েছে কিনা, পানির খুব তোড়, তাই মাছগুলো এদিকে এসে সব জড়ো হয়ে থাকে।
আনু হাঁ হয়ে যায় শুনে। এইসব কাণ্ড নাকি? একটা জায়গা বেছে নিয়ে পানু ভাই ছিপ ফেলে বসেন। তিন তিনটে ছিপ। আনু চোয়াল ঝুলিয়ে তাঁর কাণ্ডগুলো দেখে। অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ভেসে থাকা যাত্রা তিনটের দিকে। পানু ভাই তাকে একটা ফানার দিকে নজর রাখতে বলেন, তাতে সে বড় খুশি হয়ে যায়। একমুহূর্ত চোখ এদিক ওদিক সরায় না। একটা স্বপ্নের মতো লাগে আনুর।
এই বেলা তিনটের রোদ, ঝিকমিক করতে থাকা নদী, আকাশে কালো বিন্দুর মতো একটা দুটো পাখি, স্রোতের মুখে ভেসে চলা বড় বড় নৌকার মন্থর চলে যাওয়া, পাশে নিবিষ্ট মনে বসে থাকা পানু ভাই, পাড়ে ঝাউবনে বাতাসের সরসর আর কোথা থেকে উঠে আসা নিবিষ্ট সব শব্দ–বাতাসে মানুষের বহুদূর থেকে ভেসে আসকণ্ঠ, নদীর ছলছল সব মিলিয়ে এক অপরূপ মায়ার সৃষ্টি হয় আনুর মনে। সে যেন এখানে নেই, কোথাও নেই, পৃথিবী ছাড়িয়ে এক রহস্যময় জগতে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বাবা, মা, আপারা, ইয়াসিন সেপাই, সুরেন স্যার, ড্রয়িং স্যার, মহিমপুর ইস্টিশান, পোস্টাফিসে চিঠি আনতে যাওয়া সব কতদূর ফেলে এসেছে আনু। সেখানে আর ফিরে যাবার কথা মনেও হচ্ছে না তার। মনে হচ্ছে, এখানে এইভাবে সে পৃথিবীর শেষদিন পর্যন্ত বসে থাকবে পানু ভাইর পাশে।