অপরাধ নেবেন না, আমার স্মৃতিরাজ্যে শেক্সপিয়রকে দেবার মত আসন নেই–হ্যামলেট না কে যেন বলেছিলেন তার দেহে তাঁর মাতার যে অংশটুকু আছে সেটা তিনি ছিঁড়ে ফেলে দিতে চান অথচ ভুট্টোর মাতৃদেবী হয়তো সতী-সাধ্বী নারী ছিলেন। এবং আমি এসব কথা আদৌ তুলতাম না যদি ভুট্টো স্বয়ং একাধিকবার শেখ সাহেবের ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে গবেষণা করার নির্দেশ না দিয়ে থাকতেন। শেখের ব্যাকগ্রাউন্ড জানে না কে? আমারই মতো পুব বাঙলার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মামুলি মুসলমান তিনি। ভুট্টো সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন, পুব বাঙলার সমস্ত অনাসৃষ্টির জন্য দায়ী মুজিব এবং তার ব্যাকগ্রাউন্ড। একথা তথাপি তর্কাতীত সত্য যে মুজিবের মাতার সঙ্গে তাঁর পিতার বিবাহ হয়েছিল কি না সে প্রশ্ন ফরিদপুর অঞ্চলের লীগবৈরী, মুজিবের আশু পরলোক গমনাকাতক্ষী নেমকহারাম বিহারিরা পর্যন্ত করেনি এবং বিয়েটা প্রমাণ করার জন্য কোনও প্রধানমন্ত্রী হেদায়েউল্লার উপস্থিতিও প্রয়োজন হয়নি।
ভুট্টো ইসলামের কোনও নির্দেশই মানেন না। ওদিকে ভয়ঙ্কর শিয়া।
জুন্টার নির্দেশে যে মেজর জেনারেল ইসকন্দর মির্জা সর্বপ্রথম আইনত ডিকটেটর হয়ে তিন সপ্তাহ রাজত্ব করেন তিনিও গোঁড়া শিয়া। মির্জাই ধর্মভ্রাতা ভুট্টোকে আপন উপদেষ্টা রূপে বা মন্ত্রণা সভায় ডেকে নিয়ে রাজনীতির সুন্নৎ (সারকামশিসন) করান অবশ্যই শিয়া কায়দায়। অবান্তর নয় যে মির্জাকে ডিকটেটরিতে প্রমোশন দেবার ষড়যন্ত্রটা করা হয় এক শিয়া-ভবনে, ভুট্টোজনকের প্রাসাদে।
ইয়েহিয়াও গোঁড়া শিয়া। শিয়ারা বিশ্বাস করেন, সুন্নিরা তো মুসলিম নয়ই, তারা কাফির। এবং চরমপন্থি শিয়াদের স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস, সুন্নিমাত্রই ওয়াজিব উল ক অর্থাৎ সুন্নি দর্শনমাত্রই তাকে নিধন করা শাস্ত্ৰাদেশ।
ওদিকে জুন্টাতে কোনও শিয়া আছেন বলে শুনিনি। ইসকন্দরের আমল থেকে এযাবৎ জুন্টাই পাক রাষ্ট্রের একমাত্র শক্তিধর।
সেই সুন্নি জুন্টাকে বোকা বানিয়ে, পুব বাঙলার মুসলমান মাত্রই কাফির সে-তালিম মুসলমান পাঞ্জাবি-পাঠান-বেলুচের অস্থিমজ্জায় উত্তমরূপে ঢুকিয়ে দিয়ে অগণিত বাঙালি মুসলমানকে করালো খুন, তাদের অবলাদের করালো ধর্ষণ, তাদের ঘরদোরে জ্বালাল খাণ্ডবদাহন মাত্র দুটি শিয়া। অদ্যদ্ভুত পৈশাচিক নৈপুণ্য না থাকলে দুটি মাত্র শিয়া ইয়েহিয়া এবং ভুট্টো যাদের কাছে উভয়াপা-এর অগণিত সুন্নিই কাফির এক পা-এর কাফির দিয়ে অন্য পাক-এর কাফির উৎপাটন করার মতো ধৃষ্টতা হৃদয়ে ধরতে পারত কি?
হিটলার পেরেছিল কি জর্মনির কাফির ইহুদিদের বোকা বানিয়ে, তাতিয়ে দিয়ে ফ্রান্সের কাফির ইহুদিদের হত্যাধর্ষণলুণ্ঠন করাতে? দূরেই থাক সে দুরাশা! বরঞ্চ সে যাদের মর্ত্যের আদর্শ মানব (সুপারম্যান) উপাধি দিয়ে চিরজীবন প্রপাগান্ডা চালাল, সেই নর্ডিক জাতের সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ সম্ভ্রান্ত অনেক অফিসার, রমেলসহ, তিন-তিনবার চেষ্টা দিল তাকে হত্যা করতে। ফলে দু হাজার থেকে পাঁচ হাজার কে জানে কত– নর্ডিক সুপারম্যানকে মেশিনগান্-এর গুলিতে, ফাঁসিকাঠে, শক্ত সরু তারে ঝুলতে ঝুলতে আধ ঘণ্টাটাক শূন্যে পা দুটো আছড়াতে আছড়াতে এ পদ্ধতিতে ফাঁসির মতো এক ঝটকায় না–দমবন্ধ হয়ে প্রাণ দিল। এ যাবৎ কোনও শিয়ার শরীরে আঁচড়টি তক লাগেনি।
এবারে বলুন, চৌধুরী সাহেব, সেই অনামা অমর্ত্যলোকে কার নীচাসন– হিটলারের না ইয়েহিয়ার ফাঁসুড়েদের?
.
১১.
আলিঙ্গন ঘনতর করে বাষ্পভরা কণ্ঠে কীর্তি বললে, এই তো আমার অক্ষয় সম্পদ। তোমার প্রেমই আমাকে দেখিয়ে দেবে পথ, অরে দেবে আমার বুক সাহস দিয়ে, আর সবচেয়ে বড় কথা আমার মতো অপদার্থকে করে দেবে কর্মনিষ্ঠ। যেখানেই যাই না কেন, যেতে যেতে তাই ক্লান্ত হয়ে পড়ি না কেন, তোমার কথা ভাবলেই পাব নবীন উৎসাহ।
মৃদুকণ্ঠে শিপ্রা বললে, তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই।
কীর্তি কোনও উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইল।
শিপ্রা বিদায়-বেলার পীড়া হালকা করে দেবার জন্য বলল, একজন নীরবে চিন্তামগ্ন হলে অন্যজন প্রায়ই বলে, তুমি কী ভাবছ সেটা যদি আমাকে জানাও তবে তোমাকে একটা পেনি দেব– এ পেনি ফর ইয়োর থট; আমি যদি এটা পাল্টে বলে দিতে পারি, তুমি এখন কী ভাবছ, তুমি একটা পেনি দেবে?
কীর্তি তবু চুপ।
শিপ্রা বাসনার লহরে হরে রঙিন দুটি ঠোঁট দিয়ে কীর্তিকে নিবিড় চুম্বনে চুম্বনে আচ্ছন্ন করে দিয়ে বললে, তুই ভাবছিস, মিতা, এখন যদি বলি, আমাকে বিয়ে করো তবে শিপি আগের মতো আর না বলতে পারবে না, এইমাত্র যখন কথা দিয়েছে আমাকে তার অদেয় কিছু নেই বল, কিতা, ঠিক ধরেছি কি না?
কীর্তি একটিমাত্র শব্দে উত্তর দিল, ঠিক।
শিপ্রা অভিমানের ছল করে বললে, বা রে! তুমি কোনও উৎসাহ দেখাচ্ছ না যে! একদিন আমার দুর্বলতম মুহূর্তে- যেদিন আমি আমার সর্ব উজাড় করে দিয়েছিলাম তোমাকে, অগ্রণী হয়ে, নিজের থেকে নারীর শেষ সম্বল তুমি আমায় বলনি ওইটেই তোমার একমাত্র ভাবনা। আমি তখন সেটাকে হালকা করে দেবার জন্য বলেছিলুম, হৃদয় আর ভাবনা তো একই সত্তা :
কিবা সে হৃদয়? হৃদয় কাহারে কয়?
সে তো একবিন্দু শোণিত আর ভাবনার রাশি।
শেষ ভাবনা উধাও হয়ে যাবে শেষ কামনা পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। তখন রইবে শুধু একবিন্দু শোণিত; ভাবনাটা উধাও হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে তোপ হৃদয়ও। ভাবনা-ভরা হৃদয়-হারা সুন্দুমাত্র একবিন্দু শোণিত তো মানুষ ভিন্ন সব প্রাণীরই আছে। ভাবনাভরা শোণিতবিন্দুটির নামই তো কীর্তি ঠাকুর। আমার ঠাকুর। উত্তরে তুমি বলেছিলে, তোমার মন্তব্যটাতে শোণিতবিন্দুও নেই।… আজ যদি কবির সুরেলা গলার সঙ্গে আমার বেসুরো গলা মিশিয়ে অর্থাৎ একটু পরিবর্তন করে গাই, জানি সেটা জনসমাজে করলে হবে ধৃষ্টতা, কিন্তু তুমি আমি মধুর ভাষে দীন, হিয়া প্রকাশে হীন, তাই কবি সেটা ক্ষমা করবেন