সুদিন বললে, ইয়েহিয়া যদি সত্যিকার সেপাই হয় তবে পাক্কা সাড়ে তিনটি মাস ধরে ন্যাজ খেলানো কেন, বাবা? ইলেকশন হয়েছে সেই ডিসেম্বরের প্রথম হপ্তায় আর আজ মার্চের মাঝামাঝি। এখনও ডেট স্থির হয়নি এসেমরি কবে বসবে– বল না শঙ্কর তোর মামা না এসেমব্লিতে কী যেন কোন ডাঙর নোকরি করে এসেমব্লি ডাকতে কতদিন সময় লাগে? আসলে সুদিনের মতলব শঙ্করকে তাতানো। কারণ শঙ্করজীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য তর্কে সুদিনের বিপক্ষ মত তারস্বরে প্রচার করা। অন্য সর্ব বাবদে হরিহরাত্মা। আজ সব্বাইকে অবাক করে বলল, মেরেকেটে উইদ এ ভেরি লিবরেল মার্জিন– সাত দিন। কিন্তু সে প্রশ্নটা তোলার পূর্বে ভুলে যাচ্ছিস কেন, ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ইয়েহিয়া তো মার্চের প্রথম সপ্তাহে এসেমব্লি সেশন ডিক্লেয়ার করে ফের সেটা নাকচ করে দিল। কী বল, মিত্তিরঃ ইয়েহিয়া না সোলজার।
ইউনুস মির্জা মেদিনীপুর না কোথাকার খাঁটি পাতি। রঙটিও বায়স প্রায়। দেমাক করেন তিনি মোগল না পাঠান কী যেন। বলতে ভালোবাসেন উর্দু- যদিও সেটা তালতলার স্ল্যাং। বেহারের নেটিভ আবদাররা পর্যন্ত সে বত্রিশ ভাজা শুনলে মুখ টিপে হাসে। উড়ে-ঘেঁষা বাংলা শুনলে মারওয়াড়ি ত আপন বাংলার পিঠে হাত চাপড়ায়। যেন মিত্তিরকে নিয়ে মিত্রপক্ষ রচনা করার জন্য অর্থাৎ ইয়েহিয়ার পক্ষ নিয়ে বলল, কিন্তু ইয়েহিয়া যথেষ্ট কারণও দেখিয়েছেন।
কীর্তিসখা খান ফ্যাকচুরিয়াস। কারণ না কচু! লেম একিউজ এবং তার কারণ– ঘোড়াটার চারটে পা-ই আগাপাশতলা লেম।
মিত্তির কী যেন বলতে যাচ্ছিল কিন্তু খান বাধা দিয়ে বললে, লীগে-ইয়েহিয়ায় যদি একটা সমঝোতা হয়ে যায় তবে তো ল্যাঠা চুকে গেল। সে নিয়ে তর্কাতর্কি হাওয়ার কোমরে রশি বাধার মতো বিলকুল বেকার। আর যদি না হয় এবং ফলে পুব বাঙলা বিদ্রোহ করে– লীগ কুল্লে দেশের ভোট পেয়েছে তাই বিদ্রোহটা হবে তামাম দেশজুড়ে আর স্বভাবতই ইয়েহিয়া চালাবে খুন-খারাবির দমননীতি। তখন পশ্চিমবঙ্গের সাধারণজন আর ভারত সরকার রি-অ্যাক্ট করবে কীভাবে?
শঙ্কর তার পূর্বমত কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে চিন্তিত চিত্তে বললে, পাঞ্জাবি পাঠান সেপাইরা তাদের প্রতিবেশী, জাত-ভাই কাশ্মিরি মুসলমানদের সাহায্য দেবার নামে এসে তাদের ঘরবাড়ি কীরকম লুটপাট করেছিল সেটা অন্তত আমার অজানা নয়। আর এই বহুদূরের বাঙালদেশে তারা নরম চামড়ার দস্তানা পরে পিউনিটিভ অ্যাকশন নেবে, সেটা দুরাশা।
মির্জা নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, যা-ই করুক না কেন, ওটা তো পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার।
খান তো রেগে টং। ঘরোয়া ব্যাপার! আসা ডিপ্লোমেটিক ভাষা। যেটা ডাহা সত্য বিকৃতির ভদ্র বা ভণ্ড নাম। পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মেলা নিকট আত্মীয় রয়েছে পুব বাঙলায়, আর এখানে যেসব হিন্দু রেফুজি পুব বাঙলা থেকে এসেছে তাদের সে দেশে মা-ভাই রয়েছে ঢের ঢের বেশি। তাদের গায়ে বুঝি রক্ত নেই। তাদের বেলা এটা শব্দার্থে সত্যার্থে ঘরোয়া ব্যাপার। তোমার বেলা ওটা ডাহা নির্জলা ফন্দি–মানুষ মারার অজুহাত।
সুদিন বললে, ফ্রান্স-জর্মনির লড়াই ছিল ওদের দুজনার ঘরোয়া ব্যাপার। তবে কেন শতাধিক বৎসরের নিরপেক্ষ সুইটজারল্যান্ড হিটলারলাঞ্ছিত কি ইহুদি, কি জর্মন পলাতক সবাইকে আশ্রয় দিল? এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বে-আইনিভাবে। এদের প্রায় কারওরই সরকারি পাসপোর্ট, সুইস ভিসা ছিল না।
আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী উচিত যে সুইস ফ্রন্টিয়ারে সে-দেশে ঢোকার সময় যে ধরা পড়েছে তাকে ধাক্কা মেরে যে দেশ থেকে সে বেরিয়ে এসেছে সে দেশের পুলিশের হাতে সমর্পণ করা। অর্থাৎ পলাতক পুত্রকে ফের ডাইনির হাতে সমর্পণ করা। ওরা সবাই ছিল জর্মন সিটিজেন। হিটলার তাদের নিয়ে কী করবে, না করবে, সেটা তার নিতান্ত ঘরোয়া ব্যাপার। তবে সুইটজারল্যান্ডের মতো দ্র দেশ, ভদ্রতর সরকার দিনের পর দিন এরকম বেআইনি কর্ম করে ওদের ঘরোয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করল কেন? তদুপরি সুইস সরকার বেশ জানত, হিটলার যখন হল্যান্ড, বেলজিয়ামের নিরপেক্ষতা চুক্তি উপেক্ষা করে দুটো দেশ দখল করে বসে আছে তখন প্রয়োজন বোধ হলে কিংবা নিতান্তই খামখেয়ালির ঝোঁকে সুইটজারল্যান্ডকেও আক্রমণ করতে পারে। বেআইনিভাবে পলাতক জর্মনদের আশ্রয় দেবার বিগলিতাৰ্থ : সুইটজারল্যান্ড আক্রমণ বাবদে অর্ধসুপ্ত ম্যান-ইটার হিটলার বাঘার ন্যাজ ধরে হ্যাঁচকা টান মারা।
সোমেন চাটুয্যে বললে, অত সাত সুমুদ্র পাড়ি দিচ্ছ কেন বাওয়া? ওই যে তোমার পুব পাকিস্তান থেকে তেইশটি বচ্ছর ধরে কখনও বানের জলের মতো হুড়মুড়িয়ে, কখনও ঢেউয়ে ঢেউয়ে, আর ছিটেফোঁটায় তো অহরহ রেফুজি আসছে, তাদের ঢুকতে দিচ্ছ কোন আইনে। ওহে মির্জা সাহেব, ওদের ঠেলায় তোমার-আমার প্রাণ যায়। তুমি, দাদা, যাও না বর্ডারে। তোমার গভীরতম পলিটিকাল ডকট্রিন ঘরোয়া ব্যাপারটা প্রিচ করো না ওদের সামনে সবিস্তর সালঙ্কার। একটি কাজের মতো কাজ হয়।
শঙ্কর বলল, ছিঃ চাটুয্যে! মির্জা সাহেব উচ্চাঙ্গের সমাজসেবক এবং ভারতপ্রেমী। তাঁর অকাল মৃত্যু কামনা করাটা কি ব্রাহ্মণসন্তানের পক্ষে গৌরবের বিষয়!
এমন সময় বেয়ারা মিস্টার মির্জার হাতে একখানা ভিজিটিং কার্ড এনে দিল। সেটার উপর চোখ প্রায় না বুলিয়েই মির্জা সক্কলের দিকে চোখের দৃষ্টি ঘোরাতে ঘোরাতে বললে, জেন্টলমেন, আমার এক বিশিষ্ট বন্ধু লক্ষ্ণৌ থেকে এসেছেন। আপনারা যদি সদয় অনুমতি দেন তবে তাকে এখানে নিয়ে আসি, নইলে অন্য টেবিলে