অবশ্য ও-রেলি একেবারে চুপ কর রসে রইল না। কিন্তু খবর বিলোতে গিয়ে দেখল এবারে কলকাতায় সে তেমন কিছুই দেখেনি। গ্রাওে বসে লাঞ্চ খেয়েছে অথচ চারিদিকে কী হচ্ছে না হচ্ছে কিছুমাত্র লক্ষ্য করেনি, ক্যালকাটা ক্লাবের বারে বসে অনেকক্ষণ ধরে এটা-ওটা চুকচুক করেছে কিন্তু এখন আর স্মরণ করতে পারল না, পরিচিত কার কার সঙ্গে সেখানে দেখা হয়েছে।
বিষ্ণুছড়া বললেন, ও-রেলি গোপন সরকারী কাজে গিয়েছিলেন কলকাতায়, আর তার ফাঁকে করেছেন পার্টি পরব। দুটোয় জট পাকিয়ে গিয়েছে। বলে কী বলবেন, কী বলবেন না, ঠিক করতে পারছেন না।
ও-রেলি বুঝলে, এটা সোমের কীর্তি।
প্রকাশ্যে বললে, ঠিক তা নয়; তবে এখন কলকাতার মৌসুমটা মন্দা যাচ্ছে। বেশীর ভাগই দার্জিলিঙ কিংবা শিলঙে। আমার পরিচিত অলপ লোকের সঙ্গেই সেখানে দেখা হল।
মীরপুর বললেন, সে কি মিস্টার ও-রেলি? আপনি তো এক সেকেণ্ডে আলাপ জমিয়ে ফেলতে পারেন বদ্ধ কাল-বোবার সঙ্গে, আর আপনি করছেন পরিচয় অভাবের শোক।
মনের ভিতর চমক খেয়ে ও-রেলি দেখলে, কথাটা একেবারে খাঁটি। এই তার জীবনে প্রথম যে সে কলকাতায় কোনো নূতন পরিচয় জানতে পারেনি। তবে কি সে জমাতে চায়নি? কেন, কী হয়েছে তার?
কিছু একটা বলতে হয় যে লোক গল্পবাজ, সে কোনো কারণে চুপ মেরে গেলে সমাজে তার বড় দুরবস্থা–তাই আমতা আমতা করে বললে, না, না সেদিক দিয়ে আটকায়নি!’ বলতে বলতে মনে পড়ে গেল, ক্রিকেটার হেণ্ডারসনের হুয়াইটেওয়ের দোকানে তার দেখা হয়েছিল ও-রেলি বেঁচে গেল। শুধালে,–
ক্রিকেটার হেণ্ডারসনকে চেনেন?
বিষ্ণুছড়ার মেম বললেন, আমার দুরসম্পর্কের বোন-পো হয়?
মীরপুর মেম কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার পূর্বেই ও-রেলি ক্রিকেটের গল্প জুড়ে দিল-মীরপুর-
বিড়ার কথা। কাটাকাটিকে সে স্বদেশী বোমার চেয়েও বেশী ডরাত বললে, একটা ভালো ইংলিশ ক্রিকেট টীম নিয়ে আসছে-শীতে ইণ্ডিয়া আসতে চায়। ছেলেটার তাই নিয়ে উৎসাহের অস্তু নেই। ভারতবর্ষের সব কটা পিচ সে তার আপন হাতের তেলের চেয়েও ভালো করে চেনে। আমার তো মনে হ’ল পিচগুলোর বকরির মত চিবিয়ে খেয়েই যাচাই করে নিয়েছে, কোনটা বোলারের স্বর্গ আর কোনটা ব্যাটসম্যানের দরকার হলে কোয়ের মাটিঙও চিবুতে তৈরী।
আমি বললুম, অতশত মাথা ঘামাচ্ছ কেন হেণ্ডারসন, এদেশের ক্রিকেট বড় কাঁচা; তোমারা আনায়াসেই জিতে যাবে।
হেণ্ডারসন বললে, তার কিছু ঠিকঠিকানা নেই। বোম্বাইয়ের জ্যাম সায়েব–তোমরা নাকি নামটা অন্য ধরনে উচ্চারণ করে তিনি জ্যাম হোন আর জেলিই হোন, বিলেতে তিনি তাড় হাঁকড়ে সাবইকে ক-শো বার জেলি বানিয়ে দিয়েছেন, তার খবর তো তোমার অজানা নেই। কে বলতে পারে বলো, কালই এদেশে আরো পাঁচটা জ্যাম বেরিয়ে যাবে এবং হয়তো জ্যাম নয়, তার চেয়েও শক্ত মাল–হার্ড নাট।
আমি উত্তরে বললুম, অসম্ভব তো কিছুই নয়, তবে কি না কাল আমার ন্যাজ গজাতে পারে বলে আজ তো আমি তাই নিয়ে মাথা ঘামাইনে কিংবা ন্যাজ সাফসুতরো রাখার জন্য বুরুশও কিনিনে।
মাদামপুরের বুড়ো সাহেব লক্ষ্য করলেন, ক্রিকেটের গল্পে উত্তেজিত হয়ে ও-রেলি বললে, ভাবছি, শমশেরগঞ্জের জমিদারের কাছ থেকে কিছু টাকা বাগাব। সম্প্রতি লোকটা গুম-খুনে জড়িয়ে পড়েছিল–অথচ সোম পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে প্রমাণ খাড়া করতে পারলে না। আমি কিন্তু জমিদারকে ভাওতা মারলুম, সব প্রমাণ তৈরি, এবারে বাছাধনকে ঝুলতে হবে। পায়ে জড়িয়ে ধরে আর কি, তখন ভবিষ্যতের জন্য তার বুকে যমদূতের ভয় জাগিয়ে দিয়ে যেন নিছক মেহেরবানি করে তাকে ছেড়ে দিয়েছি। টাকা চাইলে এখন তার ঘাড় দেবে।
সবাই কলরব তুলে নূতন করে আবার সেই গুম-খুনের পোস্টমর্টেমে লেগে গেলেন। ইংলণ্ডে হিজ ম্যাজেস্টির পরেই ক্রিকেট আলোচনা আড্ডার রাজা কিন্তু পুব বাঙলার গুম-খুন রাজারও রাজা, অর্থাৎ মন্ত্রী-অবশ্য দাবা খেলার-রাজার চেয়ে ঢের বেশী তাগদ ধরেন। কত রকম কথা-কাটাকাটিই না হ’ল, বিষ্ণুছড়ার মেম বলছেন, জমিদারের হুকুমে বড় ভাইয়ের চোখের সামনে ছোট ভাইকে জ্যান্ত পোঁতা হয়েছিল, মীরপুরের মেম বললেন, গুলতান, লোকটার বর ভাই-ই নেই, আর সে খুন হয়নি আদপেই; মীরপুরের জমিদারের টাকা খেয়ে গুম হয়ে গিয়েছে শমশেরগঞ্জকে জড়াবার জন্য।
অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলছিল। ইতিমধ্যে ও-রেলি কেটে পড়েছে।
মাদামপুরকে বাগানে ফেরার সময় বিড়বিড় করে বলতে শোনা গেল, ও-রেলিকে বোঝা ভার।
২. বেকন আণ্ডা বজর্ন
০৬.
বরঞ্চ ইংরেজ সকাল বেলার বেকন আণ্ডা বজর্ন করে দেবে, বরঞ্চ ইংরেজ বড়দিনে গিঞ্জে কট করতে পারে, এমন কি, শাশুড়ীর জন্মদিনও ইংরেজের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভ নয়, কিন্তু ক্লাব-গমন বন্ধ করা ইংরেজের পক্ষে ভুলে যাওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু ক্লাব-গমন বন্ধ করা ইংরেজের পক্ষে হোস-অব-কমন পুড়িয়ে দেবার শামিল।
মুসলমানের কলমা ভুলে যাওয়া, হিন্দুর গো-মাংস ভক্ষণের তুলনায় চুলে চিমটি কাটার মত।
ডেভিড, মেব্ল্ তিন মাস ধরে ক্লাবে যায়নি।
যে মীরপুরের ছোট মেম ডুমুরের ফুল, সাপের ঠ্যাঙ দেখছেন বলে ক্লাবে দাবি করে থাকেন, তাঁকে পর্যন্ত স্বীকার করতে হ’ল, মধুগঞ্জের তাবৎ খানসামা বাটলার, মেথর ঝাড়দারকে ফালতো চা বখশিশ দিয়েও তিনি কারণটা বের করতে পারেননি।