পোর্ট সঈদের পাপ লুকিয়ে রাখা যায় না। মেলের চোখে পর্যন্ত তার অভদ্র ইঙ্গিত খোঁচা মেরেছিল–যদিও আমি চেষ্টার ত্রুটি করিনি ও যেন সামান্য দু-একটা কেনাকাটা করে, আর গোটা দুই মসজিদ দেখেই জাহাজে ফেরে।
শেষটায় মেবল্কে বললুম, ও যে-দেশে যাচ্ছে, সেখানকার লোক লাঞ্চ ডিনার আরম্ভ করে তোতো জিনিস দিয়ে। প্রাচ্যের সঙ্গে মোলাকাত দাওয়াতের আরম্ভেই পোর্ট সঈদের উচ্ছেভাজ-যদিও অনেক বুড়বকদের কাছে সেই বস্তুই ক্রিসমাসকে লেডি ক্যানিং বলে মনে হয়।
শোর্ট সঈদ মিশরের প্রতীক নয়, বোম্বাইকে বরঞ্চ ভারতবর্ষের শহর বলা চলে। তাই যখন বোম্বাই দেখে মেব্ল্ খুশি হলো, তখন আমার ভয়-ভাবনা অনেকখানি কেটে গেল। যদিও সে বেচারী বোম্বাইয়ের রাস্তায় হাতি সাপ আর গৌরীশঙ্করের জন্য এদিক ওদিক তাকিয়ে, দেখতে না পেয়ে একটু মনমরা হয়েছিল বৈকি?
বোম্বাইয়ে নেমেই ধরতে হ’ল কলকাতা মেবল্। সেখানে নেমে তড়িঘড়ি ফের। শেয়ালদা-গোয়ালন্দ–চাঁদপুর হয়ে মধুগঞ্জে। মে অভিভূতের মতো গাড়িতে জানালার কাছে বসে, গোয়ালন্দী জাহাজে ডেক-চেয়ারে খাড়া হয়ে দুচোখ দিয়ে বাইরের দৃশ্য যেন গিলছিল। তার কাছে সবই নুতন, সবই বিচিত্র। তার আনন্দে কিন্তু কাটা ফোঁটাতে তোমাদের দেশের দারিদ্র। স্টেশনে ভিখিরি দেখে দেখে শেষটায় বেচারী অন্য দিকে মুখ ফেরাত। বরঞ্চ আমি আয়ারল্যাণ্ডের ছেলে ইংরেজ রাজত্বের ফলে আমার দেশে কী হয়েছে, সে সম্বন্ধে আমি কিছুটা সচেতন, কিন্তু লণ্ডনের মেয়ে মেব্ল্ এ-সব জানবে কী করে? আবার সব দারিদ্রের জন্য কেবল ইংরেজই দায়ী, এই সহজ সমাধানই বা তাকে বলি কী প্রকারে? ভাবলুম, মে বোকা মেয়ে নয়, নিজের থেকেই আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝে নেবে।
মধুগঞ্জ আর আমাদের বাঙলোটি দেখে মেবল্ মুগ্ধ ঠিক একদিন আমি যে রকম মুগ্ধ হয়েছিলুম। আম, জাম, নিম, লিচু গাছের কোনটাই সে কখনো দেখেনি। খানার টেবিলে যে-সব ফল রাখা হল, তারও সব কটাই তার অজানা। কারি যে এক নয়, দশ–বিশ রকমের হয়, সে কথা মধুগঞ্জে এসে প্রথমে শুনল। এসব দেখে শুনে মেলের বিশ্বাস হ’ল, অ্যালিস ইন ওয়াণ্ডারলাণ্ডে ওয়াপ্তার করবার মতো কিছুই নেই।
এসব জিনিস তোমাকে এত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বলছি কেন সোম? একটু পরেই বুঝতে পারবে।
অ্যাকস্-আঁ-প্রভাস ছাড়ার পর মধুগঞ্জে এসেই আমাদের সত্যকার হনিমুন আরম্ভ হ’ল। হনিমুন! হায় ভগবান, না। শয়তান–কাকে ডাকব?
এক মাস ধরে প্রতি রাত্রে যে মর্মান্তিক সত্য আমার সর্বাঙ্গে চাবুক মেরে গেল, তার মূল ট্রাজেড়ি–আমি নিবীর্য–ইম্পোটেন্ট। মেব্ল্কে যৌনতৃপ্তি দেবার ক্ষমতা আমার নেই।
কথাটা কত সহজে বলা হয়ে গেল। এ রকম সহজ কথা শোনা তোমার আমার দুজনেরই অভ্যাস–পুলিশের লোক হিসেবে। জজ কত সহজ সরল ভাষায় আসামীকে বলেন, তাই তোমার ফাঁসি। কিন্তু সে কি তখন তার পূর্ণ অর্থ বুঝতে পারে? পরেও কি পারে? এর অর্থ বুঝতে হয় প্রাণ দিয়ে এবং প্রাণ দেবার পর বোঝাবুঝির রইল বা কী?
আমি ইম্পোটেন্ট। রায়টা কত সহজ। কিন্তু এর সম্পূর্ণ অর্থ আমি এখনো বুঝিনি। দিনে দিনে পলে পলে পদাঘাত খেয়ে খেয়ে যেটুকু বুঝতে পেরেছি সে জিনিস আমি তোমাকে কিংবা এ সংসারের অন্য কাউকে বোঝাব কি করে? আমার যেদিন ফাঁসি হবে সে দিন আমি বোঝাবুঝির বাইরে চলে যাব বটে, কিন্তু তোমারা হয়তো সেই দিনই খানিকটে বুঝতে পারবে।
পনেরো দিন পরে তাই আমি কলকাতা গিয়েছিলুম, ডাক্তারদের কাছে। তারা অনেক পরীক্ষা করে যা বললেন সেটাও অতি সহজ। নিজের থেকে যদি না সারে তবে ওষধ পত্রে কিছু হবে না। কলকাতার ডাক্তারদের হাইকোর্টে আমার মৃত্যুদণ্ড বহাল রইল।
ফিরে এসে যখন শুনলুম তুমি রটিয়েছ আমি কলকাতা গিয়েছি সরকারী কাজে তখনই বুঝতে পারলুম, তোমার আনকানি ষষ্ঠবুদ্ধি দিয়ে তুমি বুঝতে পেরেছ কিছু একটা হয়েছে এবং আর পাঁচজন যেন তার কোনো ইঙ্গিত না পায় তাই ও গুজবটা রটিয়েছ। থ্যাক।
এর সরল জিনিস, কিন্তু আমার কাছে এখনো এটা রহস্য।
আমি দেখতে ভালো, সৌন্দর্যবোধ আমার আছে, আমি প্রাণবান পুরুষ, আমর স্বাস্থ্য ভালো, আবার জোর দিয়ে বলছি, সোম, আমার মতো স্বাস্থ্য পৃথিবীর কম লোকই পেয়েছে, আমার অর্থের অভাব নেই। বিলাসেও আমার ঝোঁক নেই, পাঁচজনের তুলনায় আমাকে বোকা বলা যেতে পারে না, এবং সবচেয়ে বড় কথা মেবলের মতো সুন্দরী, প্রেমময়ী রমণী আমি পেয়েছি প্রিয়ারূপে, পত্মীরূপে, সে আমাকে তার সমস্ত সত্তা দিয়ে ভালোবাসে, আমাকে সে হৃদয় দিয়ে বরণ করে নিয়েছে
এই পরিপাটি প্যাটার্নটি বোনার পর ভগবানের এ কি নিষ্ঠুর ঠাট্টা না শয়তানের অট্টহাসি! এই পার্ফেক্ট প্যাটার্নটির উপর কে যেন ছড়িয়ে দিলে নিষ্পাপ শিশুকে হত্যা করে তার তাজা রক্ত। তোমাদের ভাষায় বলতে হলে, সুন্দর দুর্গাপ্রতিমা বহু যত্নে তৈরি করার পর তার উপর কে যেন ছিটিয়ে দিলে গোরক্ত। মর্মর মসজিদের মেহরাবে না পাক শুয়রের খুন!
কেন, কেন, কেন?
আমি কোনো উত্তর পাইনি।
অনেক ভেবেছি। অনেক ভেবেছি বললে অল্পই বলা হ’ল। আট বছর ধরে ঐ একটি কথাই ভেবেছি বললে ভুল বলা হবে না। কাজকর্মে লিপ্ত থাকার সময় আমার-চেতন মন এ সমস্যা ভুলে যেত সত্য কিন্তু হাতের কাজ শেষ হওয়া মাত্রই মন সেই প্রশ্নে ভুব মারত।