জায়গাটা খোঁড়ার আরেকটা কারণঃ যদি কিছু না পাই, তবে আমি সমস্ত ব্যাপারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারব।
বড় সায়েব দুহাত মাথা চেপে ধরে রইলেন অনেকক্ষণ ধরে।
ডীন সায়েবকে আরেকটা পেগ দিলেন।
সায়েব শুধালেন, তোমার কী মনে হয়?
ডীন কোনো উত্তর দিলে না, প্রশ্নটা যেন সে শুনতেই পায় নি।
এবারে সায়েব মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, এ কাজ যদি রেলির হয়, তবে বলব, যথেষ্ট ন্যায়সঙ্গত কারণ না থাকলে তার দ্বারা এটা কখনো সম্ভবপর হত না।
ডীনও উঠে দাঁড়াল। বললে, খোঁড়াখুড়ি করার আমার তৃতীয় কারণ সেইখানেই। আপনার শেষ সিদ্ধান্ত যদি ও-রেলির সপক্ষে যায়, তবে এই কঙ্কালগুলো নিয়ে আপনি যা ভালো মনে করেন তাই করতে পারবেন। এটা তো আপনার কেস।
বড় সায়েব বললেন, মাই কেন! ও গড়। বড় সায়েব পরদিনই রাধাপুর গিয়ে সোজা উঠলেন ও-রেলির বাংলোয়। কোনো ভূমিকা না দিয়েই বললেন,
ও-রেলি, মধুগঞ্জে তোমার বাংলোর বাগান খুঁড়ে তিনটি কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছে। এ সম্বন্ধে তোমার কিছু বলবার আছে কি? কিন্তু তার পূর্বে তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি তুমিও জান–
সাহেব বাক্য শেষ করলেন।
ও-রেলি তখন একটু শুকনো হেসে বললে, আমাকে কিছু সাবধান করতে হবে না। এই নিন। বলে সে কোটের ভিতরে বুকের পকেট থেকে একতাড়া কাগজ বের করে বড় সায়েবের হাতে দিলে।
.
১৪.
প্রিয় সোম,
এ চিঠিটা তোমাকে লিখছি; এ চিঠিটা বিশ্বসংসারের যে কোনো লোককে লেখা যেত। তবু তোমাকেই কেন লিখছি তার কারণ তুমি আমাকে হৃদয় আর মন দিয়ে যে রকম বুঝতে চেষ্টা করেছ এ রকমটা আর কেউ, কখনো করেনিনা এদেশে,না আমার আপন দেশে–এক মেব্ল্ ছাড়া। হৃদয় আর মন দিয়ে বলবার সময় আমি ইচ্ছে করেই হৃদয় আগে ব্যবহার করেছি তার কারণ আমি আইরিশম্যান,আমি ইংরেজ নই। আমি আমার পাঁচটা জাতভাইয়ের মতো হৃদয় দিয়ে ভাবি, আর মন দিয়ে অনুভব করি। ইংরেজ তার মনকে হৃদয়ের আগে স্থান দেয় এবং বহু ইংরেজের আদপেই হৃদয় আছে কি না তাই নিয়ে আমার মনে সন্দেহ আছে। কিন্তু থাক, এ-সব সস্তা পাইকারি হিসেবে কোনো জাত কিংবা দেশ সম্বন্ধে রায় প্রকাশ।শুধু শেষ একটা কথা বলি, বাঙালীর সঙ্গে এ বাবদ আইরিশম্যানের অনেকখানি মিল আছে। জানিনে, তোমার কাছে খবর পৌচেছে কি না, আলিপুরের মামলায় যারা হাজতে ছিল তাদের প্রতি দরদ দেখিয়ে এক আইরিশ ডাক্তারকে এদেশের ইংরেজ কর্তাদের কাছে হুমকি খেতে হয়েছে। এই আইরিশ ডাক্তারের সঙ্গে আমার হৃদয়ের মিল রয়েছে। দেশে আমার জাতভাইরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়ছে স্বাধীনতার জন্য। তাদের জন্য আমার যথেষ্ট দরদ। ওদিকে ইংরেজ আমাকে যে দায়িত্ব দিয়েছে সেটাকেও অস্বীকার করতে পারিনে। তোমার বেলাও তাই, অরবিন্দ কোম্পানির প্রতি তোমার সহানুভূতি; ওদিকে যে ইংরেজ রাজতন্ত্র এ দেশে প্রচলিত তার সদগুণগুলোও তোমার চোখ এড়ায় না। আইরিশ ডাক্তার, তোমার এবং আমার, আমাদের সকলের ভিতর একই দ্বন্দ্ব।
সাধারণ লোক এ ক্ষেত্রে বলে, তাহলে চাকরি ছেড়ে দিলেই পার? এর সদুত্তর যখন আমি আপন মনে খুজছি তখন তোমার মুরুরি–যাকে প্রথম দর্শনে মনে হয়, আস্ত একটা গাড় ড্যাম ফুল কাশীশ্বর চক্রবর্তীকে এক পুরস্কার-সভার বক্তৃতাতে অন্য কথা প্রসঙ্গে বলতে শুনলুম, সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব সংসারে তো চিরকালই লেগে থাকবে। তাই বলে কি আমরা সবাই সংসার ত্যাগ করে বনবাসে চলে যাই? আর যদি যাই-ও তাতেই বা কী? সেখানে কি দ্বন্দ্ব নেই।
কথায় কথায় কোথায় এসে পড়লুম। কিন্তু তোমার স্মরণ আছে, সোম, আমি যখন প্রথম এদেশে আসি তখন কী রকম মারাত্মক বাঁচাল ছিলুম। তুমিই নাকি মীরপুরকে একদিন বলেছিলে, সায়েব কথা কয় যেন ম্যাকসিম গানের মতো কট কট কট কট ট ট-ট। ঠিকই বলেছিলে। এবং আমিও মন্তব্যটা শুনে সেটাকে সবিশেষ প্রতিপন্ন করার জন্য আরো শ তিনেক রৌণ্ড তদণ্ডেই ছেড়েছিলুম।
সে বাঁচালতা একদিন আমার লোপ পায়। আজ আবার সেটা ফিরে এসেছে। দীর্ঘ সাত বছরের জমানো কথা আজ তোমাকে বলতে যাচ্ছি। যে কলম-ধরাকে আমি ভূতের মতো ডরাতুম, আজ আমাকে সেই কলম ধরেছে। আমার একমাত্র দুঃখ এ-চিঠি হয়তো কোনোদিন তোমার হাতে পৌঁছবে না। এটা হয়তো জবানবন্দীরূপে আদালতে পেশ করা হবে। যে অন্ন তোমাকে সাদরে আপন হাতে খাওয়াতে চেয়েছিলুম, সেটা পৌঁছবে তোমার কাছে, পাঁচশো জনের এটো হয়ে।
হ্যাঁ, আমার-ই কর্ম আমিই করেছি। এর জন্য আর কেউ দায়ী নয়। আমি একাই দায়ী। আমি জানি, একমাত্র তুমিই জানতে পেরেছিলে যে, আমি দায়ী। তুমি আমাকে ধরিয়ে দাওনি কেন তারও আন্দাজ আমি খানিকটা করতে পেরেছি। বিশ্বের আদালতে আমাকে খাড়া না করে তুমি আমাকে তোমার নিজের আদালতে খাড়া করে হয়তো যথেষ্ট প্রমাণ পাওনি, হয়তো তোমার প্রত্যয় হয়েছিল যে, এ অবস্থায় পড়লে তুমিও ঠিক এই রকম ধারাই করতে, হয়তো ভেবেছিলে আমি তোমার ওপরওলা, ওপরওলার অপরাধের বিচার করেন তার ওপরওলা, গুরুর বিচার করবেন ভগবান, চেলার তাতে কিসের জিন্মেদারি। এ নিয়ে আমার কোনো কৌতূহল নেই। জজ যখন আসামীকে খালাস দেয়। তখন জজ কেন তাকে ছেড়ে দিলে তাই নিয়ে মাথা ঘামায় কোন আসামী?
তুমি যে আমাকে হৃদয় দিয়ে খানিকট বুঝতে পেরেছিলে সে বিষয়ে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই, তুমি যেন অন্ধের মত হাতড়ে হাতড়ে গুপ্তধনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলে, এইবারে আমি তোমাকে হাত ধরে বাকিপথটুকু দিয়ে যাব। কিন্তু যদি গুপ্তধনের কলসী তখন ফাঁকা বেরোয়, কিংবা যদি তার থেকে বেরোয় কেউটে…? তখন তুমি আমাকে দোষ দিয়ো না। আর তুমি যদি তখন তোমার রায় বদলাও তবে আমিও তোমাকে দোষ দেব না।