সে কথা ঠিক, কিন্তু পাদ্রী-টিলার বাচ্চারা কোথা থেকে আসে সে তত্ত্বও তো নেটিভদের অজানা নয়।
মাদামপুর একটুখানি অসহিষ্ণু হয়ে বললেন, সে তো সাধারণভাবে, যে রকম ধরো অনাথাশ্রম হয়ে। কিন্তু এখানে সে ব্যক্তিবিশেষ, সমাজ যাকে চেনে। তা আবার এ, এস, পির মেম! মাই গড। আমি ভাবতুম, পুরুষরা এ-সব ঢলাঢলিতে যতখানি নিচু হতে পারে, স্ত্রীলোকেরা ততখানি পারে না।
দুজনেই উঠে দাঁড়ালেন। দেখা গেল বিষ্ণুছড়া আর মীরপুরের মেম আসছেন। সাপে নেউলে গল্প করতে আসছেন এ জিনিস প্রাণিজগতে কখনোই দেখা যায় না। দুর থেকে দেখে মনে হয় যেন এক লেঙ্গোটার ইয়ার–উহুঁ, এক ফ্রকের সই। অথচ এঁরা আসছেন ইনি ওঁকে ছোবল মারতে মারতে, উনি এঁকে কামড় দিতে দিতে। চোখ লাল না করে, দাঁত না খিঁচিয়ে, ফণা না বাগিয়ে ঝগড়া করতে পারে একমাত্র মানুষই–অবশ্য স্ত্রীলোকেরাই পায় মাইকেল ও-রেলি শীল্ড-পুরুষের কপালে কনসোলেশন প্রাইজ।
গুজোবটা ছড়াতে কত দিন লেগেছিল বলা শক্ত। গুজোবের স্বভাব হচ্ছে যে, প্রথম ধাক্কাতেই সে যদি কিছুটা সাহায্য না পায়, তবে কেমন যেন দড়কচ্চা মেরে যায়। ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝে মাদামপুর আর বিষ্ণুছড়া যদি সেটার টুটি চেপে না ধরতেন, তবে কী হত বলা যায় না; এ স্থলে গুজোবটাকে ফের চাঙ্গা হয়ে ছড়িয়ে পড়তে বেশ একটুখানি সময় লেগেছিল।
মধুগঞ্জে ‘আণ্ডা-ঘরে’ গুজোব-মাত্রেরই জন্মমৃত্যু জরা-যৌবনের বেশ একটা সুনির্দিষ্ট ঠিকুজি আছে। পুজোবের জননী যদি মীরপুরের ছোট মেম হন, তবে তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। অবশ্য জানা কথা, বিষ্ণুছড়ার বড় মেম তখন আঁতুড়ঘরেই বাচ্চাটাকে নুন খাইয়ে মেরে ফেলবার চেষ্টা করেন এবং আরো জানা কথা, বেশীর ভাগ স্থলেই বাচ্চা যেত। ঘোত করে নুনটা খেয়ে ফেলে দিব্য ট্যা-ট্যা করে দুধের জন্য আপন ক্ষুধা জানিয়ে দেয়। তার কারণ বিষ্ণুছড়ার বড় মেম পাঠা কাটতে চান তার পদমর্যাদার ভার দিয়ে তিনি বড় মেম, মীরপুর ছোট মেম–আর মীরপুর কাটে ধার দিয়ে। তার উপর ক্লাবে ছোট মেমদের সংখ্যা বেশী, কাজেই তারা সদলবল সায় দেয় মীরপুরের কথায় কথায়–হ্যায়, কলমাকস্ যদি আণ্ডা-ঘরে একটা টু মেরে যেতেন, তবে তিনি পতি বুর্জুয়ারী আর অৎ বুর্জুয়াজীর আড়াআড়ি সম্বন্ধে কত তত্ত্বকথা না রপ্ত করে যেতে পারতেন।
আবার বিষ্ণুছড়া যদি কোনো গুজোবের গডমাদার হন তবে সে বেচারীকে ষষ্ঠী-পুজোর দিন পর্যন্ত বাঁচতে হয় না।
মেব্লের সৌভাগ্য বলতে হবে যে, তার সম্বন্ধে গুজোবটা বিষ্ণুছড়া ক্লাবে বাপ্তি করেছিলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই মীরপুর বললেন, এ গুজোব তার কানে এসেছে বহুদিন হ’ল। তিনি এটা একদম বিশ্বেস করেননি। ও-রেলি বিপ্লবীদের পিছনে লেগেছে বলে নেটিভরা হিংসেয় এইসব আজগুবি যাচ্ছেতাই কেচ্ছা রটাচ্ছে।
অনেকক্ষণ ধরে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। সে ময়না তদন্তে মেলের গোপনতম অস্ত্রবস্ত্রের সাইজ, রঙ কিছুই বাদ পড়ল না। সেদিন কিন্তু আরেকটু হলে মীরপুরই লড়াইয়ে হেরে যেতেন, কারণ দেখা গেল মেবলের সৌন্দর্যে হিংসুটে খাটাসমুখোগুলো পাইকারি হিসেবে জুটেছে বিষ্ণুছড়ার পিছনে। আরেকটু হলে মীরপুরকে রণে ভঙ্গ দিতে হত, কিন্তু অত্যন্ত অপ্রত্যাশিতভাবে তার ফিফথ কলাম জুটে গেল, বিষ্ণুছড়ার বড় সায়েবের সাহায্যে।
এ-সব কেলেঙ্কারি-কোদল মেমেরা করে সায়েবদের বাদ দিয়ে। আজকের আলোচনা কিন্তু এতই তপ্ত গরম হয়ে উঠেছিল যে, বিষ্ণুছড়ার বড় সায়েব যে কখন এসে একপাশে দাঁড়িয়েছেন কেউ লক্ষ্য করেনি।
হঠাৎ এক সময় তার স্ত্রীর কথা কেটে দিয়ে বললেআন, শার্লট, তুমি যে কথা বলছ সেটা কি খুব রুচিসঙ্গত?।
তারপর আর পাঁচজনের একটুখানি বাও করে, আপনারা আমাকে মাফ করবেন, বলে আস্তে আস্তে বাইরে চলে গেলেন।
সবাই থ। একে অন্যের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বরঞ্চ বিষ্ণুছড়া তার খাণ্ডার মেমের কথার প্রতিবাদ না করে কোট-পাতলুন ফেলে দিয়ে আখেলার টেবিলের উপর ধেই ধেই করে নেচে নেচে ধর্মসঙ্গীত গাইতে আরম্ভ করতেন তবু আণ্ড-ঘর এতখানি আশ্চর্য হত না, কারণ এ অঞ্চলে সবাই জানে, বিষ্ণুছড়া তার মেমকে ডরান কুলীদের স্ট্রাইকের চেয়েও বেশী। তাঁর যে এতখানি দুঃসাহস হতে পারে সেকথা সম্পূর্ণ কল্পনাতীত। সবাই থ। না, ধ নয়–একেবারে দ, ধ, দন্ত্য ন–বর্ণমালার শেষ হরফ পর্যন্ত।
সম্বিতে ফেরার পর মীরপুরের ছোট মেম ফিসফিস করে এস. ডি. ও’র মেমকে বললেন, নিশ্চয়ই এক জালা হুইস্কি খেয়েছে, বাঘের চর্বির সঙ্গে ককটেল বানিয়ে।
এস. ডি. ওর মেমের সরসিকারূপে খ্যাতি ছিল। ক্লাব থেকে বেরতে বেরতে বললেন, হ্যাঁ, একটা ছবিতে দেখছিলুম, হুইস্কির পিপে থেকে ছ্যাদা দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা হুইস্কি চুঁইয়ে বেরচ্ছে। এক ইঁদুরছানা সেইটে চুকচুক করে চুষে হয়ে গিয়েছে বেহেড। মাতাল। লাফ দিয়ে পিপের উপর উঠে আস্তিন গুটিয়ে চিৎকার করে বলছে, ঐ ড্যাম ক্যাটটা গেল কোথায়? নিয়ে এসো এইখানে আমি ব্যাটার সঙ্গে লড়ব।
মীরপুর বললেন, ভালো গল্প; টমকে বলতে হবে। আপিসের কাউকে ডিসমিস করতে হলে সেই সাত-ছটার সময় হুইস্কি খেয়ে আপিস যায়।
এস, ডি, ওমেম বললেন, আজ রাত্রে বেচারী পার্সির ডিনার জুটবে না। ওকে পট লাকে নেমন্তন্ন করলে হয় না? হঠাৎ কথা বন্ধ করে বললেন, ঐ দেখো, পার্সিকে ফেলে বেটি মোটর হাঁকিয়ে বাড়ি রওয়ানা হয়েছে। এই বয়সে পার্সি বেচারীর কী করে টাক হ’ল বুঝতে কষ্ট হয় না। তালুতে যে কুল্লে আড়াইখানা চুল আছে সেগুলোও আজ রাত্রে ছেঁড়া যাবে।