মরে যাবে? রেশমিকে এমনভাবে কেন চেপে ধরবে যে, ও মরে যাবে? রেশমি মরে গেলে ওর কী হবে?
ফরসা, রোগা মেয়ে ছিল রেশমি। একমাথা বাদামি চুল। গালে একটা তিল। ওকে দেখলেই দম বন্ধ হয়ে আসত মাহিরের। রেশমিকে বলতও সেই কথা। শুনে রেশমি হাসত, বলত, “ছেলেগুলোকে চিনি না? বদের বাসা! হিট উঠে গেলে যা খুশি তাই বলে! শুধু শোওয়ার ধান্দা!”
কিন্তু মাহিরের সেসব উদ্দেশ্যই ছিল না। সেই ক্লাস ইলেভেন বয়সটায় রেশমি বললে ও গলফ গ্রিনের টিভি টাওয়ার থেকে ঝাঁপও দিতে পারত।
কিন্তু রেশমি সেসব বুঝল না। ফাগুন মাহাতোর সঙ্গে এক সপ্তমী পুজোর দিন পালিয়ে গেল।
ন’বছর হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজও মাহিরের ভিতরের জ্বালাটা মরেনি। ও চলে যাওয়ার পর তো পড়াটাও ছেড়ে দিয়েছিল মাহির। সারাক্ষণ ঘর অন্ধকার করে বসে থাকত। খেতে চাইত না। খালি মনে হত বজবজ লোকালে গলা দেয়! মনে মনে দেখত ফাগুন আদর করছে রেশমিকে। সম্ভাব্য সমস্ত রকম আদর যেন মনে মনে দেখতে পেত ও। আর বুকের পাঁজরে আগুন লেগে যেত! সারা শরীর পুড়তে শুরু করত ওর! পাগলের মতো লাগত মাহিরের। মনে হত সাপে কেটেছে ওকে। বিষ ছড়িয়ে যাচ্ছে সারা দেহে। বুঝত, এই বিষ বাকি জীবন বয়ে যাবে ওর শিরায় শিরায়।
সারা জীবন? সত্যি? না, সারা জীবন আর নয়। সত্যি করে বলতে গেলে সেভাবে হয়তো প্রেম আর নেই, কিন্তু কোথায় যেন একটা হেরে যাওয়া আছে। জ্বালাটা যে হারের সেটা বুঝতে পারে এখন। বুকের ভিতরের রাবার গাছ থেকে সারাক্ষণ টপ-টপ করে রস চুঁইয়ে পড়ে! খালি মনে হয় আধবুড়ো ফাগুনের কী ছিল, যা ওর ছিল না? উত্তরটা অবশ্য খুঁজতে হয় না। উত্তরটা ও জানে। টাকা। জমি-ব্যাবসার দালালির টাকা।
টাকাটাই মেরে দিল মাহিরকে। সব কিছুতেই পিছন থেকে টেনে ধরল। সেই রেশমি থেকে এই বুট অবধি। টাকা কিছুতেই এগোতে দেয় না ওকে।
পতাদা চলে যাওয়ার আগে বলল, “কী করিস, একটা বুটও কিনতে পারিস না!”
মাহির উত্তর দিতেও পারত, কিন্তু দিল না। কী হবে মুখ নাড়িয়ে। পতাদা বলবেই। তার চেয়ে একটা নতুন বুট পেলে ভাল হবে।
সুমিত উঠল, “কী রে, তোকে ছেড়ে দেব?”
মাহির মাথা নাড়ল, “না, আমি হেঁটেই চলে যাব। টিটি আসবে জাহাজবাড়ির সামনে।”
সুমিত কাঁধ ঝাঁকাল, “কী যে করিস মাহির! এখনও বলছি এইচএস-টা দিয়ে দে প্রাইভেটে। খেলার পাশে অন্তত এইচএস-টা হয়ে থাকলে সুবিধে পাবি।”
মাহির হাসল। বিষণ্ণ হাসি। সুমিত বুঝবে না। ওকে তাই বলে লাভ নেই। লেখাপড়ায় তো খারাপ ছিল না মাহির। মাধ্যমিকে লেটার ছিল চারটে। স্টার পেয়েছিল। ওদের ওই স্কুল থেকে মাত্র দুটো ছেলে পেয়েছিল স্টার। তার মধ্যে এই মাহির বসু একজন। ইংরেজিতে খুব ভাল ছিল ও। স্যার বলতেন, “মন দিয়ে পড়িস মাহির। জীবনে সব কিছু আমাদের ছেড়ে যায়, কিন্তু অর্জন করা বিদ্যে কখনও ছেড়ে যায় না। এর চেয়ে ভাল বন্ধু আর কেউ নেই।”
স্যারের কথা আজও খুব মনে পড়ে মাহিরের। ইলেভেন থেকে টুয়েলভে ওঠার পরীক্ষায় ইংরেজিতে একশোয় বিরাশি পেয়েছিল মাহির। স্যার নিজে ওকে একটা বই দিয়েছিলেন। ইংরেজিতে লেখা আইনস্টাইনের জীবনী। বইটা আজও আছে মাহিরের কাছে। শুধু বইটাই আছে। আর সব যেন হারিয়ে ফেলেছে ও! রেশমি চলে গিয়েছে, সঙ্গে করে বাকি জীবনটাও নিয়ে গিয়েছে।
সুমিত বলল, “হাসছিস? কিন্তু একদিন এর ফলটা ভুগবি। আমি ঠেকে শিখেছি। আটাশ হল আমারও। যদি বিএসসি-তে ব্যাকটা ক্লিয়ার করে রাখতাম, আজ শালা দাদার লেদের কারখানায় ঘানি ঘোরাতে হত না!”
ওরা মাঠের বাইরের দিকে হাঁটতে লাগল।
বড় রেলিং দিয়ে মাঠটা ঘেরা আছে। সন্ধের ঘোলাটে আলো বিশাল প্লাস্টিকের মতো এসে নামছে শহরের মাথায়। আস্তে-আস্তে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের আলো জ্বলছে। চিড়িক চিড়িক করে জেগে উঠছে বড়-বড় বিলবোর্ড। গাড়ির ছবি। বড় হাউজ়িং-এর ছবি। বিদেশে ঘুরতে যাওয়ার প্যাকেজের ছবি। প্রতিদিন মাঠ থেকে বেরোনোর আগে এই বিলবোর্ডগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখে মাহির। এত টাকা মানুষ পায় কোথা থেকে? কে দেয় এত টাকা তাদের? ওর মা মাসে আট হাজার মতো পায়। তাতে ওদের তিনজনের চলতে দম ফুরিয়ে যায়! সেখানে এসব কেনে কারা?
মাঠের বাইরে এসে ফুটপাথের উপর স্ট্যান্ড করা মোটরবাইকটার সামনে দাঁড়াল সুমিত। পিছনের ক্যারিয়ারে ব্যাগটা আটকে রেখে বলল, “কী রে, আজ এত ডাউন কেন? বাড়িতে প্রবলেম?”
মাহির উত্তর দিল না। দেখল, মাঠ থেকে বিশু, সঞ্জয়, মইদুল, মনা, সুব্রত, বাবু এক-এক করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কেউ ওকে দেখে হাসছে। কেউ পিঠ চাপড়ে দিচ্ছে। সবার মুখই কেমন যেন ম্লান! কেমন যেন ইস্ত্রি-বিহীন সব হাসি। এখানে কেউ আলো টাঙিয়ে দিয়ে যায়নি!
সুমিত বলল, “এই মাহির, কী হয়েছে তোর? তেমন হলে বলিস আমি তোকে জুতো কেনার টাকা ধার দেব। ভাবছিস কেন?”
মাহির হাসল এবার। সুমিত সেটা দিতেই পারে। যতই বলুক ওর দাদার লেদের কারখানায় ও ঘানি ঠেলছে, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেছে মাহির। যথেষ্ট ভাল অবস্থা। না হলে কেউ এমন আশি হাজার টাকার বাইক কিনতে পারে? মাহির জানে কারও-কারও দুঃখ নিয়ে বিলাসিতা করার একটা অভ্যেস থাকে। সুমিতেরও তেমন আছে। পড়ত ওর মতো ঘরে! থাকত অমন বস্তিতে! সবার সঙ্গে লড়াই করে জল নিতে হত। মাতালদের চিৎকারের মাঝখানে ঘুমোতে হত। আচমকা মারামারির মধ্যে, বোমাবাজির মধ্যে বাড়ি ফিরতে হত, তখন এসব বাতেলা বেরিয়ে যেত।