শীত শেষ হয়ে গিয়েছে কলকাতায়। তবে এখনও সেই গরমটা পড়েনি। ফেব্রুয়ারির এই তৃতীয় সপ্তাহে আকাশটা কেমন যেন ব্লটিং পেপারের মতো হয়ে আছে।
মাহির বলল, “হাসছিস কেন? স্পনসরের কথা যে বলল সেদিন। বলল কুড়ি লাখ টাকা দেবে নাকি তারা?”
“টাকা গাছে ফলে?” সুমিত এবার জল খেল একটু। তারপর বোতলের মুখটা বন্ধ করে বলল, “শোন, ওসব ছেঁদো কথা। গত্তি নেই। আমাদের টিম কি বার্সেলোনা নাকি? সেকেন্ড ডিভিশনের মাঝামাঝি একটা টিম। চ্যাম্পিয়ন হব, সেই দম নেই আমাদের। কে টাকা দেবে? কেনই-বা দেবে?”
মাহির কী বলবে বুঝতে পারল না। গত সপ্তাহে ফ্রেন্ডস ইউনিয়নের সঙ্গে খেলায় জিতেছে ওরা। পরিষ্কার টু-নিল। তারপর মাঠের পাশে দাঁড়িয়ে পতাদাই স্পনসরের কথাটা বলেছিল।
বলেছিল, “আজকের মতো যদি খেলতে পারিস তবে আর চিন্তা নেই। পরের চারটে ম্যাচ জিতলেই আমরা কিন্তু টপ থ্রি-তে পৌঁছে যাব। একটা সিমেন্টের কোম্পানির সঙ্গে কথা হয়েছে। ওরা বলেছে কুড়ি লাখ টাকা দেবে। ভাবতে পারছিস ব্যাপারটা? তোদেরও কিছুটা দেখতে পারব। সুতরাং, ঢিলে দিবি না। জান লড়িয়ে দে। ফার্স্ট ডিভিশনে উঠতে পারলে ভাবতে পারিস কী হবে?”
সেদিন থেকে কুড়ি লাখ টাকা মাথায় ঘুরছে মাহিরের। মাসে চার-পাঁচ হাজার টাকাও যদি ক্লাব দেয়, তবেই তো অনেক। ও তো মনে মনে ভেবেই নিয়েছিল সহজে কাউকে ডিফেন্স দিয়ে বল নিয়ে গলতে দেবে না।
“কী রে, কী ভাবছিস?” সুমিত ঠেলল মাহিরকে।
মাহির মাথা নাড়ল, “কিছু না। পতাদা হেবি ঢপবাজ। ধুর, আমি আর খেলব না।”
“কেন?” সুমিত চোখ গোলগোল করল।
মাহির উত্তর দিতে গিয়ে সামলে নিল নিজেকে। প্র্যাকটিস শেষ করে পতাদা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। বাকিরাও যে যার মতো মাঠে ছড়িয়ে বসে আছে।
লেকের দিক থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসছে এখন। আপ বজবজ লোকাল লেক গার্ডেন্স ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে বালিগঞ্জের দিকে। আর পাখি উড়ছে। আকাশে ভুরু এঁকে পাখির ঝাঁক হাওড়ার দিকে থেকে উড়ে যাচ্ছে বারুইপুরের দিকে। কেমন একটা মনখারাপ করা আলো যেন ভাসছে। সূর্য নেই, তবু তার ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ফেলে যাওয়া আলোয় দিনটা কেমন যেন নিচু হয়ে এসে মাথায় লাগছে মাহিরের।
ক’টা বাজে? আলো দেখে সময় বলে দিতে পারে মা। ও পারে না। কিন্তু ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করতেও লজ্জা করছে। গতকাল হাত থেকে পড়ে গিয়ে মোবাইলটার পেছনের দিকের ঢাকনাটা খুলে গিয়েছে। কিছুতেই আর আটকাতে পারেনি। পরানদার দোকানেও নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরানদা বলেছে, এমন করে ভেঙেছে আর জোড়া লাগানো যাবে না। গোটা ফেসিয়া পালটাতে হবে। কিন্তু এত পুরনো মডেল, ফেসিয়া পাওয়াও নাকি কঠিন।
পরানদা বলেছিল, “আরে, নতুন ফোন নিয়ে নে। এসমার্ট ফোন। বড় স্কিরিন! ভাল করে ছবি আর ভিডিয়ো দেখতে পাবি।”
শেষের কথাটা বলার সময় চোখ টিপেছিল পরানদা। কিন্তু মাহির ওসব পাত্তা দেয়নি। বড় স্ক্রিন! স্মার্ট ফোন! কে দেবে টাকা? পরানদা? না পরানদার বাপ?
গতকাল থেকে একটা রাবার ব্যান্ড দিয়ে ফোনটাকে পেঁচিয়ে রেখেছে ও, না হলে ব্যাটারিটা পড়ে যেতে পারে। খুব বদখত লাগছে দেখতে। তাই সবার সামনে সেটা বের করতে ইচ্ছে করছে না। লজ্জা করছে।
“কী রে, তুই কুল ডাউনের আগেই বসে পড়লি কেন?” পতাদা এসে কোমরে হাত দিয়ে সামনে দাঁড়াল।
মাহির মাথা তুলে তাকাল। বিরাট বড় ভুঁড়িটার জন্য কেমন একটা লাগছে। গায়ের টি-শার্টটা কোমরের দিকে উঁচু হয়ে আছে। পইতেটা সামান্য বেরিয়ে ঝুলছে। পতাদার মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি। মাথার চুলের আসল রং কলপের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে পড়ায় মাথাটা কেমন যেন দোয়েল পাখির মতো লাগছে।
মাহির এসব দেখতে-দেখতে তাকিয়ে থাকল।
“কী রে শালা?” পতাদা খিঁচিয়ে উঠল, “বয়রা হয়ে গেছিস? উত্তর দে! ডিসিপ্লিন নেই কিছু? শো-কজ় করব?”
মাহিরের মনে হল বাছা-বাছা কিছু গালাগালি দেয়! শো-কজ়! পাজামার বুক পকেট!
কিন্তু নিজেকে সামলাল ও। তারপর বলল, “বুটটা গিয়েছে পতাদা। ছোটনকে দিয়েছিলাম সারাতে। কিন্তু পারেনি ভাল। পেরেক বেরিয়ে গিয়েছে।”
“তো?” পতাদা বলল, “জানিস, আমরা কেমন খেলেছি? পেরেক-ফেরেক কিচ্ছু মানিনি। একবার ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে খেলা ছিল। কৃশানু, বিকাশ, চিমা। কে নেই ওদের টিমে! কিন্তু আমরা যা ফাইট দিয়েছিলাম না! আমারও সেদিন বুটে প্রবলেম ছিল। কিন্তু আমি কি পিছিয়ে এসেছি? আজও সবাই বলে সেই ম্যাচটার কথা।”
মাহিরের মুখটা আপনা থেকেই বেঁকে গেল! পতাদা এত বাতেলা করে না! সবাই জানে, পতাদার মতো ভুলভাল ঢপ কেউ মারে না!
ও বলল, “কিন্তু পতাদা, পা কেটে যাবে। ওই বুটে খেলা যাবে না।”
“তবে?” পতাদা তাকাল, “পরশু ম্যাচ আছে। তুই আমার রাইট ব্যাক। তোকে ভেবেই টিম করেছি। এখন বলছিস বুট খারাপ? আর বুট নেই?”
মাহির মাথা নাড়ল, “পরার মতো নেই। পুরনোটা আছে, কিন্তু স্টাডস গিয়েছে।”
পতাদা চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বলল, “ঠিক আছে, কাল আয়, দেখব। কী যে করিস! কত নম্বর পা তোর? দশ?”
মাহির আবার মাথা নাড়ল, “এগারো।”
“এগারো?” পতাদা অবাক হল, “মাইরি! রাবণ নাকি তুই?”
শরীরটা ওর বড়সড়। ছ’ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা। চওড়া কাঁধ আর বুক। ভুঁড়ি নেই একটুও। ঢালাই লোহার শরীর। বাদামি চামড়ায় মাছি পিছলে যায়। রেশমি বলত, “তোর সঙ্গে কে প্রেম করবে? চেপে ধরলে আমি মরেই যাব।”