পেখমের বলতে ইচ্ছে করেনি, কিন্তু তবু নিজের অজান্তেই যেন বলে ফেলল, “তুমি চাকরির কিছু করলে? আর কতদিন ওইসব পার্টি-টার্টি করবে?”
এবার তাকাল কাজু। যেন কিছুটা সময় নিল শব্দগুলোকে নিজের মনের মধ্যে বসে যেতে দিতে। তারপর বলল, “তুমি যা চাও, তা কি হবে কোনওদিন?”
“কেন হবে না?” পেখমের গলা শক্ত হল এবার, “এমন খারাপ কিছু ভেবো না।”
কাজু বলল, “না হলেও আমার কবিতা থাকবে। তোমায় নিয়ে লেখা সব কবিতা।”
“আমার ওসব চাই না!” পেখম দ্রুত চুপ করিয়ে দিতে চাইল কাজুকে। বলতে চাইল কাজুকেই শুধু চায় ও। আর কিছু নয়। কিন্তু বলতে পারল না। বরং কেমন এক অভিমান এসে বুজিয়ে দিল ওর গলা! কাজু সব সময় কেন এমন মনখারাপের কথা বলে! কেন কাছে এসেও আবার এমন সরে-সরে যায়!
কাজু দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর শান্ত গলায় বলল, “যদি আমরা এক হতে নাও পারি, তাও এই সময়গুলো তো আর মিথ্যে নয় পেখম। এই রাত। এই জ্যোৎস্না। এই সব কবিতা তো আর মিথ্যে নয়! যে যার মতো যা খুশি ভাবুক, আমি আমার লেখা তোমার জন্য রেখে যাব। আমার বাদামি ডায়েরির সব লেখা শুধুমাত্র তোমার জন্য রেখে যাব। আমি যদি তোমায় খুঁজে নাও পাই, সেই ডায়েরি তোমায় খুঁজে পাবে পেখম। সেইসব কবিতা তোমায় খুঁজে পাবে। আর এই শব্দগুলোর অর্থ কেবল আমরাই জানব। মাত্র আমরা দু’জন জানব!”
.
০২. মাহির
বুটটা খুলে ভিতরে হাত ঢুকিয়ে দেখল মাহির। পায়ে কী যেন একটা খোঁচা দিচ্ছিল। কাঁকর নয়। থাকলে ঝাড়লেই বেরিয়ে যেত। কিন্তু বেরোয়নি। ও হাত ঢুকিয়ে দেখল। আঃ। কী এটা? আঙুলটা বের করল মাহির। ছোট্ট এক বিন্দু রক্ত ফুটে উঠেছে আঙুলের ডগায়। ভেতরে কি পেরেকটা জেগে উঠল!
বিরক্তিতে মাহিরের মুখটা বেঁকে গেল। আচ্ছা জ্বালাতন তো! এই তো সেদিন বুটটা ঠিক করাল, এর মধ্যেই আবার পেরেক বেরিয়ে এসেছে!
শালা, বুটটাকে বিরক্তিতে পাশে ছুড়ে মারল মাহির। পরশুদিন খেলা আর আজই বুটটা বেগড়বাই করছে! কপাল তো নয়, যেন টালি নালা!
সামনের দিকে তাকিয়ে মেজাজটাই খিঁচড়ে গেল মাহিরের। সকলে প্র্যাকটিস করছে আর ও বসে বসে ছিঁড়ছে! এখনই পতাদা খিস্তি করবে ওকে এমনভাবে বসে থাকতে দেখলে। বলবে, টিম থেকে লাথি মেরে বের করে দেবে, যদি না পরিশ্রম করে! পরিশ্রম! নিজে বিরাট ভুঁড়ি নিয়ে বাঁশি মুখে পিঁ পিঁ করে হুমদো হয়ে ঘুরবে, আর দূর থেকে চেঁচাবে, সে বেলায় কিছু নয়! ভাটের যত কথা! পরিশ্রম!
পতাদা মানে পতঞ্জলি লাহিড়ি, লেক অ্যাভিনিউ ক্লাবের সেক্রেটারি কাম কোচ। নিজে দীর্ঘদিন কলকাতার মাঠে খেলেছে। তারপর লেক অ্যাভিনিউতে এসেছে। মাহিরকে পতাদাই এই সেকেন্ড ডিভিশন ক্লাবটায় নিয়ে এসেছে বছরদুয়েক হল। কিন্তু তা বলে মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?
জার্সি, মোজা, প্যান্ট আর রুটি-কলা, ঘুঘনি-পাঁউরুটি ছাড়া ওদের কিছু দেয় ক্লাব? কিচ্ছু না। তবে অত “পরিশ্রম, পরিশ্রম” করে চেঁচায় কোন মুখে? এই টিম কি আর সেকেন্ড ডিভিশন চ্যাম্পিয়ন হবে কোনওদিন? কোনওদিন হবে না। তাই বেকার খেটে লাভ কী? তার চেয়ে রিতুদার কথাটা মেনে নিলেই ভাল হবে বোধহয়!
মাহির আবার বুটটা তুলে ভেতরে সাবধানে হাত ঢোকাল। এই তো পেরেকটা। বেশ কিছুটা বেরিয়ে আছে পাশ থেকে। তাই ডান পায়ের বুড়ো আঙুলে লাগছিল। শালা গিয়ে ছোটনের মুখে ছুড়ে মারবে। এই সারিয়েছে? নিজেকে মুচি বলে কোন মুখে?
টিটি ঠিক বলেছিল। ছোটনকে দেওয়াই ঠিক হয়নি। হাওয়াই চটির স্ট্র্যাপ পালটে পালটে মালটার অভ্যেসটাই বিগড়ে গিয়েছে! বাঁদরের হাতে বন্দুক পড়লে যা হয়, তাই হয়েছে!
মাহির দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুতোটা সরিয়ে রাখল। এক-একটা ভাল বুটের কী দাম! শুনলে মাথায় জাঙিয়া পরতে ইচ্ছে করে। ওসব কেনার সাধ্য নেই মাহিরের। এই ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর, তাও কিছু কাজ তো জোটাতে পারল না। মায়ের আয়ার চাকরির উপর ভরসা। তার উপর ভাই আছে। ভাইয়ের পিছনেই তো দেদার টাকা যায়! সেখানে কোন মুখে মাকে বলবে, বুটটা আর চলছে না! পরশু ম্যাচে কী পরবে!
মাহির ব্যাগের ভিতর বুটটা ঢুকিয়ে নিল। তারপর প্লাস্টিকে জড়ানো হাওয়াই চটিটা বের করে পায়ে পরে নিল। জার্সি আর প্যান্টটা বাড়ি গিয়ে ছাড়বে।
“কী রে, গুটিয়ে ফেললি?”
মাহির পেছন ফিরে তাকাল। সুমিত দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সুমিত সামান্য হাঁপাচ্ছে। হাতের গ্লাভসটা খুলে বসে পড়ল মাটিতে। তারপর আবার বলল, “পতাদা মাইরি লাল সুতো, নীল সুতো বের করে দিচ্ছে! আমি মাইরি গোলকিপার, আমায় ছ’বার মাঠ চক্কর মারাচ্ছে কেন? আমি অলিম্পিকে দশ হাজার মিটার দৌড়োব নাকি?”
মাহির দেখল, পতাদা বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে কুল ডাউন এক্সারসাইজ় শুরু করে দিয়েছে। মানে আজকের মতো প্র্যাকটিস শেষ!
ও বলল, “প্র্যাকটিস তো শেষ।”
“তুই তো আগে থেকেই বসে গেলি। পতাদা দেখেছে কিন্তু। খিস্তি করবে।”
“আমার এইটা,” মাহির রেগে গিয়ে বুড়ো আঙুল দেখাল, “করুক খিস্তি। আমার বুটের হাল খারাপ খুব। কবে থেকে পতাদাকে বলছি, তুমি বুটটা দাও। শোনে কথা?”
সুমিত হাসল, “আরে, দেবে কোথা থেকে? ক্লাবের হাল জানিস না?”
“কেন, স্পনসর?” মাহির তাকাল সুমিতের দিকে।
সুমিত নিজের ব্যাগ থেকে তোয়ালে বের করে মাথাটা মুছল। তারপর হাসল।