ঠাকুরদা বলেছিলেন, “অন্য মাস্টার পড়ালে হবে না?”
“না,” জেদি গলায় বলেছিল পেখম, “ওকেই আমি মজা দেখাব।”
ঠাকুরদা হেসেছিলেন শুধু। আর কিছু বলেননি।
রেজ়াল্ট বেরোনোর পরের ছুটি চলছিল স্কুলে। অন্যদিন হলে বান্ধবীদের বাড়িতে যেত পেখম। কিন্তু সেদিন কোথাও যায়নি। বুকের মধ্যে কেবল ছটফট করছিল একটা কাঠবেড়ালি! কেবলই মনে হচ্ছিল, কী হবে? কাজুকে কি বলবে বাবা? মা কী বলবে? ঠাকুরদা কি বলে দেবে বাবাকে যে, পেখম ওসব বলেছে?
সারা দিন কেমন একটা ম্যাজম্যাজে শরীর নিয়ে কেটেছিল। বুকের ভিতর একটা কষ্ট। মনখারাপ। কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছে করছিল না। টেটু এসেছিল গল্প করতে, পেখম ওকেও ফিরিয়ে দিয়েছিল। কথা বলেনি। দুপুরে খায়নি ভাল করে। মা এসে কপালে হাত দিয়ে দেখেছিল জ্বর এসেছে কি না। পেখম ওসব খেয়াল করেনি।
তারপর সারা বিকেল চুপ করে ও পুকুরের দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। ওই পাড়ে ঘোষদের বাড়ি। অন্য পাশে সর্দারদের বাঁশবাগান। পেখম দেখছিল কীভাবে আকাশের রং পালটে, গাছের পাতাদের রং পালটে, পুকুরের জলের রং পালটে সূর্য ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে পশ্চিমের আকাশে। হাওয়া দিচ্ছিল চ্যাটার্জিপাড়ার দিক থেকে। ঝিরিঝিরি নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছিল ডিসেম্বরের আলো। শীতের বিকেলগুলোয় যে এত মনখারাপ জমা হয়ে থাকে, সেদিনই যেন জানতে পেরেছিল ও! আর এর মধ্যে পেখমের কেবলই মনে পড়ছিল ওই কোঁকড়া চুল, পাতলা খাড়া নাক। মনে পড়ছিল নরম ঘাসের মতো দাড়ি! এত কষ্ট হচ্ছিল যে, নিজের মনটাকে কিছুতেই সামলাতে পারছিল না। শুধু মনে হচ্ছিল, বাবা কি শুনবে ঠাকুরদার কথা?
ছোটকার সেদিন ডে শিফট ছিল। রাতে সকলে একসঙ্গেই খেতে বসেছিল ওরা। বাবার মুখ দেখে পেখম বুঝতে পারছিল, কিছু একটা হয়েছে। ও রুটির টুকরোগুলো ছিঁড়ছিল, ডালে ডোবাচ্ছিল, কিন্তু খেতে পারছিল না। মা অবাক হয়েছিল খুব। তাকাচ্ছিল বারবার। এমন তো করে না পেখম। আজ তবে কী হল?
কথাটা শুরু করেছিলেন ঠাকুরদাই। বলেছিলেন, “সাবু, তুই কি ওই মাস্টারের সঙ্গে কথা বলেছিলি?”
বাবা চট করে একবার তাকিয়ে নিয়েছিল মায়ের দিকে। তারপর আলতো গলায় বলেছিল, “হ্যাঁ বাবা, ওই কাজুকে বলেছি পড়াতে আসতে!”
“কী?” মায়ের গলায় যে-চকোলেট বোমাটা ফেটেছিল সেটার ওপর শেষ মুহূর্তে মা নিজেই বালি চাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। আসলে ঠাকুরদার সামনে কেউ গলা তোলে না! তাও শব্দের গুণ বালিতে ঢাকা পড়েনি খুব একটা! পেখম সন্ত্রস্ত হয়ে তাকিয়েছিল মায়ের দিকে।
বাবা বলেছিল, “বাবা বললেন, তাই… মানে…”
বাবার ফেলে রাখা অসমাপ্ত বাক্য শেষ করেছিলেন ঠাকুরদা। বলেছিলেন, “সাবুকে আমি বলেছি ওই মাস্টারকে বলতে। দোকানে শুনি আমার নাতনি নাকি খারাপ লেখাপড়ায়। তাই নাকি ওই চ্যাংড়াটা বলে বেড়াচ্ছে ওর দ্বারা কিছু হবে না! আমাদের বাড়ির মেয়েদের লেখাপড়া হবে না? বললেই হল? আমি তাই সাবুকে বলেছি ওকেই পড়াতে বলতে। পেখম ওকে এবার দেখিয়ে দেবে, কার কী হবে আর কী হবে না!”
মায়ের মুখটা লাল হয়ে গিয়েছিল একদম। ঠাকুরদার সামনে কিছু বলতে পারছিল না, কিন্তু আবার সহ্যও করতে পারছিল না। শুধু থালা-বাসনের ঝংকার বেড়ে গিয়েছিল এর পর।
রাতে চাপা গলায় মা বলেছিল, “তোমার আমায় বিয়ে করা উচিত হয়নি। কোনও ক্রীতদাসীকে নিয়ে আসা উচিত ছিল!”
বাবা বলেছিল, “নমি, এমন বোলো না। জানোই তো, বাবার মুখের উপর কিছু বলা যায় না। তা ছাড়া রাস্তায় এসব শুনে বাবার রাগ হয়েছে। সোনাঝুরির মতো ছোট জায়গায় সব কথাই তো ওড়ে! তাই…”
“তুমি দেখো, একদিন কী হয়! সেদিন, সেদিন কিন্তু…” মায়ের কথাগুলো ডুবে গিয়েছিল কান্নায়। পাশের ঘর থেকে পেখম শুনেছিল বাবা বলছে, “আমি তো আছি নমি। তোমার মেয়ের কিছু হতে দেব না। দেখো।”
পরের দিন সকালে দোকানে যাওয়ার আগে পেখমের ঘরে এসেছিলেন ঠাকুরদা। তারপর নিচু স্বরে বলেছিলেন, “দেখিস, আবার কেলেঙ্কারি কিছু বাঁধাস না। মনে রাখিস, আমাদের সমাজ কিন্তু কাজুদের সমাজ নয়।”
“তুমি কী ভাল কবিতা বলো!” পেখম আলতো গলায় বলল।
এবার চোখ খুলল কাজু। তারপর আকাশের দিকে মুখ তুলে বলল, “আমি আস্তে আস্তে জমাচ্ছি, জানো! কবিতা জমাচ্ছি।”
“বই করবে?” পেখম আগ্রহভরে তাকাল কাজুর দিকে।
কাজু দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, “তার জন্য টাকা দরকার। আমার নিজের টাকায় বই করা হবে না। তবে কেউ যদি করে… কলকাতায় কেউ যদি…”
পেখম আলতো করে হাতটা ধরল কাজুর। বলল, “ঠিক হবে, দেখো।”
হাতটা সরিয়ে নিল কাজু, “এমন কোরো না পেখম। জানোই তো সব। তোমার কাকিমা নীচে আছেন। বললেন, একটু পরেই চা নিয়ে আসবেন। তা ছাড়া তোমার মা যদি এসে যান…”
পেখম বলল, “ওসব বাদ দাও। আমায় কবিতার বইটার কথা বলো। কতগুলো হয়েছে?”
কাজু বলল, “হয়েছে কিছু। একটা ডায়েরিতে ফ্রেশ করে রাখছি। তোমায় দেখাব একদিন।”
“সত্যি?” পেখম বড়-বড় চোখ করল। দেখল, কাজু আবার তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। আজ ভরা পূর্ণিমা। নিকানো আকাশে টলটল করছে আলোভরতি একটা বেলুন! পেখমের কষ্ট হচ্ছে শরীরে। মনে হচ্ছে আর দূরে থাকতে পারছে না কাজুর কাছ থেকে। সেই নাইন থেকে এই সেকেন্ড ইয়ার। কম দিন তো হল না!