পেখমের চোখে জল এসে গিয়েছিল এবার। এসব কী বলছে মা? কাজু তো কিছুই খায় না! পেখম কতবার বলে বলে খাওয়ায়। আর খাওয়া দেখেই বোঝে এসব কিছুতেই কোনও আগ্রহ নেই ওর। শুধু বই-খাতায় ডুবে থাকে ছেলেটা! কতই-বা বয়স! ইসকুল যেতে-আসতে তো কাজুর বয়সি ছেলেদের দেখে পেখম। সব এক-একটা বখাটে। শুধু সাইকেল নিয়ে চক্কর মারবে। চিঠি ছুড়বে। দেব আনন্দের গান গাইবে! এত বিরক্ত লাগে পেখমের! এরা কী ভাবে? জীবনটা হিন্দি সিনেমা? এরা বোঝে না কোনও মেয়ে এসব অসভ্যতা পছন্দ করে না? কাজুর ওই আনমনা ভাবটাই পেখমকে টানে। ওই যে কোনও কিছুতেই কিছু যায় আসে না। কিছু না হলেও চলে যায়, এমন ভাবটাই পেখমকে দুর্বল করে দেয়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে! কাজুকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে।
সেই কাজুকে আসতে বারণ করে দেবে বাবা! তবে ওর কী হবে? নিজেকে চড় মারতে ইচ্ছে করছিল পেখমের। এসব কী করল ও? এমন বোকার মতো জিনিসটা বুঝতে পারল না? কাজু যখন পড়াতে আসত, মা তো সারাক্ষণ নানা অছিলায় ঘরে ঢুকত। আড়চোখে দেখত কাজুকে। পেখম বুঝত, মা বিরক্ত হচ্ছে! কেন হচ্ছে সেটাই শুধু বুঝত না। আর তাই তো পেখমের উচিত ছিল আরও ভাল করে পড়া। ওর তো বোঝা উচিত ছিল যে, রেজ়াল্ট খারাপ হলে মা প্রথমেই কাজুর আসা বন্ধ করে দেবে।
সেদিন রাতে দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি পেখম। ওর ছোট্ট ঘরটার জানলা দিয়ে আকাশ দেখা যায়। মশারির ভেতর শুয়ে পেখম এপাশ-ওপাশ করেছিল বহুক্ষণ। তারপর একসময় আর থাকতে না পেরে উঠে বসে খুলে দিয়েছিল জানলা। তাকিয়েছিল বাইরের দিকে। আকাশের দিকে। আর তখনই দেখেছিল জোনাকিদের! বাড়ির পাশের বড় ঝোপের মধ্য থেকে আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছিল জোনাকির দল। সবুজাভ আলোয় আশপাশের সব কিছু কেমন যেন মায়াবী হয়ে উঠেছিল। পেখম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল সেই দিকে। আকাশের দিকে কেন উড়ে যাচ্ছে জোনাকিরা? কী চায় ওরা? কাদের কাছে পৌঁছতে চায়? আকাশের সব তারাই কি একসময় মাটির এই জোনাকি ছিল?
কতক্ষণ বসেছিল মনে নেই পেখমের। শুধু যখন পুব আকাশে লাল রং লেগেছিল, যখন মাধব বৈরাগী খোল-করতাল নিয়ে বেরিয়েছিল নামগান করতে আর ঠাকুরদার গলায় কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম শুনেছিল, তখন সংবিৎ ফিরেছিল পেখমের। আর তখনই বুঝতে পেরেছিল ওর কী করা উচিত। ঠাকুরদা! এমন বিপদে ঠাকুরদাই ভরসা। বাড়িতে কেউ ঠাকুরদার ওপর কথা বলে না। ঠাকুরদা আছেন বলেই এখনও বিরাট বড় কোনও ঝগড়া হয় না এই বাড়িতে। ঠাকুরদার সামনে কেউ গলা তুলে কথা বলে না।
ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে ঠাকুরদা ভগবানের নাম করেন। তারপর নিজেই ছোট্ট একটা হিটার জ্বালিয়ে চা বানিয়ে নেন। সঙ্গে দুটো পটল বিস্কুট বের করেন ডালডার টিন থেকে। তারপর বারান্দায় বসে খান সময় নিয়ে। খাওয়া শেষ হলে ঠাকুরদা মাফলার জড়িয়ে বেরিয়ে পড়েন হাঁটতে। পাশের বাড়ির ফুলুদাদুও হাঁটেন ঠাকুরদার সঙ্গে। দু’জনেই একসঙ্গে এই দেশে এসেছিলেন। ফুলুদাদু ঠাকুরদার ছোটবেলার বন্ধু। খুব মজার মানুষ ফুলুদাদু। পেখমের সঙ্গে একদম বন্ধুর মতো মেশেন!
ঠাকুরদা হাঁটতে যাওয়ার সময় মা ওঠে। দরজা জানলা খোলে। তারপর ধীরে ধীরে দিনের কাজ শুরু করে।
পেখম বুঝেছিল ঠাকুরদাকে ধরতে হলে এখনই ধরতে হবে। মা উঠে পড়লে আর হবে না।
নিজের ছোট ঘরের দরজাটা খুলে পা টিপে-টিপে বেরিয়েছিল পেখম। শীতকাল। মেঝে যেন বরফ দিয়ে তৈরি! গায়ে চাদরটাকে ভাল করে জড়িয়ে নিয়ে ও গিয়ে দাঁড়িয়েছিল ঠাকুরদার কাছে।
ঠাকুরদা সবে চা বানিয়ে বড় একটা কাপে ঢালছিলেন। এমন সময় পেখমকে দেখে কেমন যেন অবাকই হয়েছিলেন।
পেখম চুপ করে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সামনে।
“কিছু বলবি?” ঠাকুরদা তাকিয়েছিলেন।
“ঠাকুরদা, তুমি বাবাকে একটু বলবে?”
“আমি?” ঠাকুরদা অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন, “কী হয়েছে তোর? এমন মুখ-চোখ কেন? রেজ়াল্ট খারাপ হয়েছে বলে তোর মনখারাপ? অমন হতেই পারে।”
“কাজুদা আমায় আর পড়াবে না বলেছে!”
“কে?” ঠাকুরদার বুঝতে যেন একটু সময় লেগেছিল।
“আমায় যে পড়ায়। ওই যে ছেলেটা। খুব ভাল স্টুডেন্ট। বলেছে, এমন রেজ়াল্ট করেছি তো, তাই পড়াবে না। তুমি বাবাকে বলবে একটু যে, ও-ই যেন আমায় পড়ায়!”
“কেন?” ঠাকুরদা চায়ে চুমুক দিয়ে সামান্য নাক কুঁচকেছিলেন। তারপর রান্নাঘরের তাক থেকে চিনির কৌটো পেড়ে নিয়ে এসে বলেছিলেন, “কী হয়েছে কী?”
“আমায় অপমান করেছে কাজুদা, মানে ওই ছেলেটা,” পেখম ঠোঁট কামড়ে তাকিয়েছিল ঠাকুরদার দিকে।
ঠাকুরদা কি ওর মিথ্যেটা ধরতে পারলেন?
ঠাকুরদা একচামচ চিনি নিয়ে কাপে গুলতে গুলতে বলেছিলেন, “ছেলেটা নিজেই পড়াবে না বলেছে?”
“হ্যাঁ,” পেখম অভিনয়টা যথাসাধ্য বজায় রেখে বলেছিল, “আমি নাকি বাজে লেখাপড়ায় বলে পড়াবে না! আমি দেখিয়ে দিতে চাই ওকে ঠাকুরদা। তুমি বাবাকে বলো।”
ঠাকুরদা সময় নিয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বলেছিলেন, “তাই?”
বাইরে থেকে হাওয়া আসছিল। বারান্দার পাশেই বড় পুকুর। শীতের এত ভোরে ঠান্ডা হাওয়ায় শিরশির করছিল পেখমের শরীর। ঘুমও আসছিল। সারারাত জেগে থাকার শোধ তুলছিল শরীর। তাও চোখ টান করে তাকিয়েছিল পেখম। মুখটাকে অপমানের ওজনে ভার করে রেখেছিল!