পুশকিন বুঝতে পারল, কেন! হাসি পেল ওর। দেখল পেছনের ডিকি উঠে গেছে। তার আড়ালে স্মরণ আর ড্রাইভার দাঁড়িয়ে!
নোঈ এখনও মুখ ভার করে আছে।
ও বলল, “আমার প্রায় সাঁইত্রিশ বছর বয়স। এটা মাথায় আছে তো?”
“আমারও ছাব্বিশ। আমি বাচ্চা নই। আর হঠাৎ বয়স দিয়ে কী হবে? আপনি চলে যাচ্ছেন যান!”
পুশকিন হাসল এবার। তারপর কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে হাতে দিল নোঈর। বলল, “এটা খোলো। আমার সামনে এখনই প্যাকেটটা খোলো।”
নোঈ অবাক হল সামান্য। কিন্তু কিছু বলল না। ও যত্ন করে প্যাকিংটা বাঁচিয়ে খুলল প্যাকেটটা। আর খুলেই অবাক হয়ে গেল। আরে, এটা কী!
নোঈ দেখল, কাচের স্বচ্ছ গোলক। তার মধ্যে অদ্ভুত দেখতে একটা প্লাস্টিকের পোকা। ও অবাক হয়ে তাকাল, “কী এটা?”
পুশকিন হাত বাড়িয়ে গোলকটার তলার একটা বোতাম টিপে দিল। আর নোঈ দেখল, পোকাটার নীচের দিকে জ্বলে উঠল হলদে-সবুজ নরম এক আলো। সেই আলোয় ভরে গেল নোঈর করতল।
“জোনাকি!” নোঈ অবাক হয়ে তাকাল পুশকিনের দিকে!
পুশকিন বলল, “আমার হয়ে তোমার কাছে থাকুক জোনাকি।”
নোঈ তাকিয়ে রইল পুশকিনের দিকে। তাকিয়েই রইল। ওর চোখে জল এসে গেল প্রায়।
পুশকিন আলতো করে কাছে টানল নোঈকে। তারপর নরম বলল, “এই রাস্তায়, এই শহরে, এই রোদে, হাওয়ায় তোমার গন্ধ লেগে আছে নোঈ! আমি তোমার কাছ থেকে দূরে গিয়ে থাকতে পারব না! আমি…”
নোঈ আর কথা শেষ করতে দিল না। পুশকিনের জামাটা খামচে ধরে কাছে টেনে আনল। তারপর ঠোঁটে চেপে ধরল ঠোঁট। জিভ দিয়ে স্পর্শ করল জিভ। এবং সমস্ত রোদ আর মেঘ একসঙ্গে পালটাপালটি করে নিল সেই ছোঁয়ায়! পালটাপালটি করে নিল গ্রহ, তারা, উল্কা আর গোটা সৌরমণ্ডল! তারপর পুশকিনের গলার কাছে মুখ গুঁজে বলল, “আমি মরে যাব!”
গাড়ি থেকে নেমে পুশকিন দেখল একটা ট্রলি নিয়ে এসে তাতে সব লাগেজ তুলে দিয়েছে স্মরণ। ও হাসল ছেলেটাকে দেখে। সেই একই রয়ে গেল। সেই আধগোঁজা জামা, না-আঁচড়ানো চুল! টেরিকটের প্যান্টের সঙ্গে সবুজ স্নিকার! নাক থেকে বারবার নেমে যাওয়া চশমা!
ও হাত বাড়িয়ে ধরল স্মরণের হাত। বলল, “পরের বার যখন আসব, প্যাঁওকে দেখব কিন্তু!”
স্মরণ হেসে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “কী জানি! প্যাঁও যা রাগী! কে জানে কী করবে!”
নোঈ একটু পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ লাল। পুশকিন হাসল শুধু। তারপর দু’জনের দিকে হাত নেড়ে এগিয়ে গেল গেটের দিকে।
গেটের কাছে গিয়ে সামনে দাঁড়ানো বন্দুক হাতে সিকিয়রিটির দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। বলল, “জাস্ট আ সেকেন্ড,” বলে লাগেজের ট্রলিটা এক পাশে রেখে আবার দৌড়ে ফিরে এল গাড়ির কাছে।
দেখল, ওকে এভাবে আসতে দেখে স্মরণ আর নোঈ একটু ঘাবড়ে গিয়েছে!
স্মরণ তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস, “কী হয়েছে স্যার?”
পুশকিন হাত তুলে ওকে থামিয়ে ওদের সামনে এসে দাঁড়াল। তারপর ভুরু কুঁচকে বলল, “তোমাদের একটা কথা বলা হয়নি। আচ্ছা, তোমাদের পাসপোর্ট আছে?”
“মানে?” স্মরণ ঘাবড়ে গিয়ে তাকাল।
“মানে পাসপোর্ট! দেশের বাইরে যায়… সেই পাসপোর্ট! আছে?”
নোঈ আর স্মরণ মাথা নাড়ল একসঙ্গে!
পুশকিন চিন্তিত মুখে বলল, “ও আছে! আচ্ছা!”
“কেন?” নোঈ অবাক হল।
পুশকিন সময় নিল একটু। তারপর বলল, “না, আসলে, বুদাপেস্টের কাজের জন্য বস আমায় টিম ঠিক করতে বলেছিলেন। তো আমি তোমাদের নাম বলেছি। বস রাজি। দু’মাসের মধ্যে এখানকার পেপারওয়ার্ক শেষ করে এই প্রজেক্টটা কনস্ট্রাকশন টিমকে হ্যান্ডওভার করে দিয়ে তোমাদের চলে আসতে হবে ওখানে। বাড়িতে সেভাবে বলে দাও। আর স্মরণ, নো প্যাঁও এক্সকিউজ় দিস টাইম। মনে থাকবে?”
নোঈ থমকে গেল যেন। তারপর সব ভুলে আচমকা “শয়তান!” বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুশকিনের ওপর!
নোঈর দু’হাতের মধ্যে ডুবে যেতে-যেতে পুশকিন শুনল স্মরণ বলছে, “নাঃ, সব মেয়ে প্যাঁওয়ের মতো নয়। প্যাঁও হলে জড়িয়ে ধরত না, কামড়ে দিত!”
তারও বেশ কিছু সময় পরে প্লেনের জানলায় বসে বাইরের দিকে তাকাল পুশকিন। সবে মাটি ছেড়ে আকাশে উঠেছে ওরা। আর নীচে ছোট-ছোট বাড়িঘরের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তাদের আলো। অসংখ্য ছোট-ছোট আলো। যেন জোনাকি!
পুশকিন ভাবল, এই তো আসল জোনাকিদের বাড়ি! অন্ধকারের মধ্যেও জ্বলে থাকার জেদ আছে যার, সেই জোনাকিদের বাড়ি! জানলার কাচে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল পুশকিন। আর দেখতে পেল বহু দশকের ওপার থেকে কোন এক জোনাকি যেন আলো জ্বেলেছিল। আর সেই আলোটুকু বুকে নিয়ে আজও এক বৃদ্ধা বেঁচে আছেন!
এই আলোটুকুই মানুষের সম্বল। অন্ধকারে তার পথ দেখানোর প্রদীপ। তার বিশ্বাস… তার বেঁচে থাকা… অন্ধকারের মুখে ছুড়ে দেওয়া তার সাহস। এই আলোই তার ধ্রুবতারা। এই আলোই তার জোনাকি। এই আলোই আসলে তার জীবন।
.
“আর তারপর আমি নিয়ে এসেছি পাঁচ হাজার বছরের পুরনো এক ইতিহাসের অংশ! বলা হয় এটির প্রচলন হয়েছিল চিনদেশে! পাঁচ হাজার বছর আগের চিনদেশে! সে সময় ফারাওরা রাজত্ব করছে ইজিপ্টে! ভারতের উত্তর-পশ্চিমে মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পা ছড়িয়ে দিয়েছে নিজের ডালপালা। ব্যাবিলনে, অ্যাসেরিয়ায় জমজমাট শহর। আর ইউরোপের মানুষ বাস করছে গুহায়! হ্যাঁ বন্ধুরা, আমি নিয়ে এসেছি তখনকার এক ঐতিহাসিক পানীয়! আচমকা আবিষ্কৃত এই পানীয়টি চিনের সম্রাট থেকে প্রবাহিত হয়ে অতীশ দীপঙ্করের পেয়ালা ছুঁয়ে এসে পৌঁছেছে মহারানি ভিক্টোরিয়ার প্রাতরাশের টেবিলে। আমি সেই পানীয় নিয়ে এসেছি যা বন্ধুত্বের হাইফেন, আড্ডার সূত্রধর, একাকী মানুষের অপেক্ষার সঙ্গী, অবহেলিত বৃদ্ধ-বৃদ্ধার শেষ সকালের প্রাতরাশ, ঠিকে ঝিয়ের মাইনের বাইরের আহ্লাদ, ছোট বাচ্চার বড়দের মতো হয়ে ওঠার চাবিকাঠি, বিকেলের মাথা ধরার ওষুধ, ভিনদেশি রেল স্টেশনের উত্তাপ, ট্র্যাফিক পুলিশের ‘আঃ’, অফিসের করিডরে পিএনপিসি-র অনুপান, স্ট্রাগলার ছেলেটার সারা দুপুরের খিদে মারার উপায়! ইতিহাস থেকে নেমে আসা এই বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পানীয়টি আজ আমি এনেছি আপনাদের জন্য। এই হরি সামন্তর চা আসলে চা নয়, এক তরল ইতিহাসের সাক্ষী। এমন সুযোগ হারালে আপনাকে ইতিহাস ক্ষমা করবে না! মাত্র পাঁচ টাকার বিনিময়ে আপনি নাম লেখান ইতিহাসে! এ সুযোগ হারাবেন না! এখনই আসুন, পান করুন, পান করান— চা!”