দীপমালাদেবী তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে, “কী তাই? নয়না সুজিতকে ছবি দেখিয়েছিল? সুজিতকে?”
বিজন কিছু না বলে মাথা নামিয়ে নিয়েছিলেন।
“বল বিজু! আজ আমায় বল। চুপ করে থাকিস না! আমি এতগুলো বছর ভেবেছি কী হল লোকটার। ওই লোক মানুষ মারবে? নয়না সুজিতকে পেল কোথায় যে, ছবি দেখাবে? বল আমায়!” দীপমালাদেবী বিজনকে ধরে ঝাঁকিয়েছিলেন।
বিজন মাথা নামিয়ে বলেছিল, “শুনতে পারবে তো?”
“পারব, বল!” দীপমালাদেবী চশমাটা খুলে চোয়াল শক্ত করে তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে।
বিজন সময় নিয়েছিলেন আরও। পুশকিন বুঝতে পারছিল এই গল্পের মধ্যে ও সম্পূর্ণ অনাহূত। বুঝতে পারছিল, আজ এমন কিছু বেরিয়ে আসছে যা টাকা, পয়সা, জায়গা, জমি, সম্পত্তির চেয়ে দীপমালাদেবীর কাছে অনেক দামি!
বিজন ঢোঁক গিলে বলেছিলেন, “নয়নাদি ছবিটা দেখিয়েছিল তোমার বাবাকে। সবুজজেঠুকে।”
“কী!” দীপমালাদেবীর হাত থেকে পড়ে গিয়েছিল চশমা, “বাবা! আমার বাবা!”
বিজন বলেছিলেন, “কাজুদা মারা যাওয়ার পরে নয়নাদি কেমন যেন পাগলি-পাগলি হয়ে গিয়েছিল। নিজেই তো বলেছিল আমায়। বলেছিল এটা হবে বুঝতে পারেনি। সবুজজেঠু, তোমার হাজ়ব্যান্ড, সবার মোটিভগুলো এক হয়ে গিয়েছিল শেষে। তাই আর ওরা বাঁচতে দেয়নি কাজুদাকে। কিন্তু ভাবো পেখমদি, ছেলেটার দোষটা কী ছিল? তোমায় ভালবেসেছিল আর যাদবকাকাদের বাঁচাতে চেয়েছিল! এই তো! ভাল কাজ করলে বুঝি এই হয়!”
দীপমালাদেবী ধীরে-ধীরে মাথা নামিয়ে ফেলেছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। টপটপ করে জল পড়ছিল টেবিলে।
“পেখমদি! পেখমদি!” বিজন ঝুঁকে পড়েছিলেন। দীপমালাদেবী বিজনের শরীরে ভর দিয়ে, বিজনকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন! বাচ্চাদের মতো কাঁদছিলেন!
বিজন পুশকিনের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, “বাইরে খবর দে পুশকিন। পেখমদি বাড়ি যাবে। আজ আর কথা নয়।”
পুশকিনের নিজেকে কেমন যেন বাচ্চা ছেলে মনে হচ্ছিল! ও দ্রুত বাইরে গিয়ে জানিয়েছিল দীপমালাদেবীর শরীর ভাল লাগছে না। গাড়ির ব্যবস্থা করতে। শোনামাত্র লোকজন ঢুকে এসেছিল ঘরে। কিন্তু দীপমালাদেবী আর কারও সঙ্গে কথা বলেননি। বিজন দীপমালাদেবীকে নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গিয়েছিলেন।
দু’দিন পরে মালিক গ্রুপ থেকে ডাক এসেছিল পুশকিনের। সে সময় অফিসে বেরোনোর তোড়জোড় করছিল ও। কিন্তু জরুরি তলব বলে রাজারহাট না গিয়ে মালিক গ্রুপের অফিসে দৌড়েছিল। দেখেছিল, অল্পবয়সি একটা মেয়ে বসে আছে দীপমালাদেবীর ঘরে।
নামটা জেনেছিল পুশকিন। রাধিয়া মালিক।
রাধিয়া বলেছিল, “এই যে সব পেপার্স। তবে একটা কথা। বিজনদাদুকে নিয়ে আমি যাব জোনাক-বাড়িতে। একটা জায়গা খুঁড়তে হবে। কী একটা নাকি পাওয়া যাবে মাটির তলায়। আপনারা কি যাবেন?”
মেয়েটা বাচ্চা। কিন্তু খুব ভদ্র আর স্মার্ট। পুশকিনের মনে হয়েছিল এমন একটা মেয়ে এই বয়স থেকে অফিসে আসতে শুরু করল!
রাধিয়া বলেছিল, “দেখবেন, যেমন প্রমিস করেছেন, তেমন যেন কাজ হয়। মিল যেন বন্ধ না হয়। এর জন্য অন্য একজন মানুষকে অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে।”
পুশকিনরা গিয়েছিল জোনাক-বাড়িতে। স্মরণ আর পুশকিন, সঙ্গে রিতুদাও ছিল সেদিন। আর সবাইকে অবাক করে সঙ্গে গিয়েছিলেন দীপমালাদেবী!
জোনাক-বাড়ির পেছনে বিজনের কথামতো খোঁড়া হয়েছিল মাটি। বেশ অনেকটা খোঁড়ার পর পাওয়া গিয়েছিল রাবারের পাতলা শিটে জড়ানো বাঁধানো একটা খাতার খুব ঝুরঝুরে কিছু অংশ আর একটা লকেট। চৌকো রুপোর লকেট। খাতার যে সামান্য দু’-চারটে পাতা পড়া যাচ্ছিল, স্মরণ সেই অংশগুলোর ছবি তুলে নিয়েছিল। পুশকিন অবাক হয়ে দেখেছিল অন্যদিনের চেয়ে স্মরণ সেদিন চুপ করেছিল একদম। মোবাইলে ফোটো তোলার সময় ছেলেটার মুখ-চোখ কেমন যেন লাল হয়ে গিয়েছিল!
ডায়েরির সামান্যটুকু আর হারটা বিজন দিয়েছিলেন দীপমালাদেবীকে। রাধিয়া বসেছিল পাশে।
দীপমালাদেবী ধীর গলায় বলেছিলেন, “এই বাড়িতে একসময় আমি আসতাম। প্রচুর জোনাকি উড়ত এখানে। অদ্ভুত একটা আলো ভেসে থাকত হাওয়ায়। এখানে মাঝে মাঝে বসে থাকত কাজুদা। ওর সাইকেল ছিল একটা। আমাদের বাড়িতে সেই সাইকেল নিয়ে যেত। যেদিন আমাদের বাড়িতে প্রথম আসে, আমি একটা লাল চাদর গায়ে দিয়ে দু’হাতে দুধের গেলাস ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কাজুদা এসেছিল একটা লাল-হলুদ ডোরাকাটা মাফলার আর নীল রঙের ফুলহাতা সোয়েটার পরে। রোদের ঢালু মিনারের ভেতর সোনাকুচির মতো ধুলো উড়ছিল। তার মধ্যে কাজুদার হালকা দাড়ি আর টানা-টানা চোখ কেমন যেন স্বপ্ন থেকে উঠে আসা মানুষের মতো লেগেছিল আমার। প্রেম হওয়ার পরে, আমি বলেছিলাম আমার সঙ্গে যেন পালিয়ে যায়। কাজুদা প্রথমে যেতে চায়নি। কিন্তু তারপর সেই গেল… একা… সবার আড়ালে! পুশকিন, এই বাড়িটাকে ভাল করে সারিয়ে তুলো। কোনও অযত্ন যেন না হয়! অনেক ভরসা করে এটা দিলাম কিন্তু তোমার দায়িত্বে। মনে রেখো, সোনাঝুরির সবচেয়ে প্রিয় মানুষটা একসময় এখানে থাকত। এখানে থাকতেন বেঞ্জামিন কূজন সরকার।”
এয়ারপোর্টের সামনে গাড়িটা দাঁড়াতেই স্মরণ পেছনে ঘুরে বলল, “স্যার, আপনারা বসুন। আমরা লাগেজ নামাই। দু’জনে বসুন, কেমন?” বলেই পাশের ড্রাইভারকে একরকম ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে নিয়ে গেল গাড়ির বাইরে।