বিকেল নামছিল তখন কলকাতায়। কাচের জানলা দিয়ে মেঘলা আকাশ আর বৃষ্টি দেখা যাচ্ছিল। ডিপ্রেশন কাটছিল না কিছুতেই। ঘরে আলো জ্বলছিল। আর তাতে এই বয়সেও দীপমালাদেবীকে মোমের মূর্তির মতো লাগছিল ঠিক। এখনও কী করে কেউ এত সুন্দর থাকে! সোনালি রিমলেস চশমা আর কাঁচায়-পাকায় ঢেউ খেলানো চুল। দেখলেই কেমন একটা দম আটকে আসে! মনে হয় এঁর সামনে কথা বলবে কী করে!
ওরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতে, দীপমালাদেবী হাত দিয়ে ওদের বসতে বলেছিলেন।
বড় মেহগনি কাঠের টেবিল। দুটো নরম গেস্ট চেয়ার। ঘরে আসবাব খুব কম। টেবলেও একটা ইন্টারকম আর দুটো পেন ছাড়া ঠাকুরের ফোটো ছিল মাত্র। সবেতেই কেমন একটা পরিমিতির ছাপ। কেমন একটা নির্জনতা।
ওরা বসার পরে, পুশকিনের দিকে তাকিয়ে দীপমালাদেবী বলেছিলেন, “আপনি এখনও হাল ছাড়েননি। আমি তো বলেছি, মিলটা নিন। পাশের জমিও নিন। কিন্তু ওই বাড়ি পরিত্যক্ত হলেও আমি এখন দেব না। আমার উত্তর না পেলে আমি দেব না।”
পুশকিন হেসেছিল। তারপর বলেছিল, “সেই জন্যই আমি এসেছি ম্যাম। উনি…”
কিন্তু পুশকিনকে হাত দিয়ে থামিয়েছিলেন বিজন। তারপর সোজা তাকিয়েছিলেন দীপমালাদেবীর দিকে। বলেছিলেন, “আমায় একটুও চিনতে পারলে না পেখমদি? আমি সত্যি এত বুড়ো আর দূরের হয়ে গিয়েছি!”
দীপমালাদেবী থমকে গিয়েছিলেন একদম। সোজা হয়ে বসে তাকিয়েছিলেন সামনে। মুখটা কেমন যেন লাল হয়ে গিয়েছিল আচমকা! চোখের দৃষ্টি পালটে গিয়েছিল নিমেষে! এই বয়স্ক মানুষটাকে ছিঁড়ে কবেকার পুরনো দীপমালা বেরিয়ে আসতে চাইছিল যেন!
বিজন বলেছিলেন, “শুধু কি তোমরা দু’জনই জানতে? আমি কি একটুও কিছু জানতাম না পেখমদি!”
দীপমালাদেবী যেন পাথরের মূর্তি হয়ে গিয়েছিলেন। পলক পড়ছিল না চোখের। শুধু অস্ফুটে বলেছিলেন, “বিজন! বিজু!”
বিজন বলেছিলেন, “কাজুদা চলে যাওয়ার পর তুমি সবার সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলে। কিন্তু আমি কী করেছিলাম পেখমদি? আমার কী অন্যায় ছিল? আমি তো কিছু করিনি! আমি তো তোমার সঙ্গে কতবার যোগাযোগ করতে চেয়েছিলাম। দাদুর দোকানে গেলাম। তোমাদের বাড়ি সামনে গেলাম। একবারও তুমি আমায় ডাকলে না। কথা বললে না। আমি তো দেখেছিলাম, সেই মেঘলা রাতে কী হয়েছিল। আমি তো ফিরে-ফিরে গিয়েছিলাম। কিন্তু দেরি হয়ে গিয়েছিল। আমি নিরুপায় হয়ে দেখেছিলাম সবটা। আর আমার পাশে বসে সবটা দেখেছিল আর-একজন। ঝিকুদা।”
দীপমালাদেবী কথা বলতে পারছিলেন না। থরথর করে কাঁপছিলেন।
বিজন উঠে গিয়ে দীপমালাদেবীর পাশে হাঁটু মুড়ে বসে হাতটা ধরেছিলেন। বলেছিলেন, “তুমি আমার কথাও শুনতে চাওনি। জানতে ইচ্ছে করেনি, কী হল মানুষটার? তোমায় মানুষটা তো ভালবাসত খুব পেখমদি!”
“ইচ্ছে করেছিল তো রে বিজন। কিন্তু মা, কাকিমা, ছোটকা… আমায় কীভাবে ঘরে আটকে রেখেছিল সেটা জানিস না। ওরা বলল কাজুদা বোমা মেরেছে। দু’জন মারা গেছে বোমায়। কাজুদা বোমা মারবে? এটা হয়?”
পুশকিন দেখেছিল দীপমালাদেবী কাঁদছেন! যেন ভুলেই গিয়েছিলেন পুশকিন বসে রয়েছে সামনে!
বিজন বলেছিলেন, “যাদবকাকা বিক্রি হয়ে গিয়েছিল পেখমদি। আমি তো আর জানতাম না! আমি তাই বলে দিয়েছিলাম, কোথায় আছে কাজুদা। বদমাশটা বলে দিয়েছিল ওদের। আর ওরা… আমার মনে কেমন একটা কুডাক দিয়েছিল জানো! তাই ফিরে গিয়েছিলাম। আর দেখেছিলাম… আমি দৌড়ে যেতে গিয়েছিলাম, কিন্তু ঝিকুদা যেতে দেয়নি। শুধু বলেছিল, আমাকেও বিলকিস করে দেবে। আমি আজও চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই… আজও!” মাথা নিচু বিজনের চোখ দিয়ে জল পড়ছিল টপটপ করে।
দীপমালাদেবী কোনও কথা বলছিলেন না।
বিজন আবার বলেছিলেন, “আমি সব দেখেছি পেখমদি… সব… কে-কে ছিল… কী হল, সব!”
“ওরা মেরে ফেলেছিল কাজুদাকে! আর জানিস আমায় বলেছিল, গা-ঢাকা দিয়েছে ও! মানুষ মেরে নাকি গা ঢাকা দিয়েছে! কিন্তু আমি জানি তা নয়। জানি তা হতেই পারে না,” দীপমালাদেবী অসহায়ের মতো তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে।
“পারে না-ই তো পেখমদি। আমি দেখেছি ওদের। ওরা মেরে তুলে নিয়ে গেল। লাশটা কোথায় গুম করে দিল। নদীতে ভাসাল না পুঁতে দিল… কে জানে! আর যাদবকাকা কাজুদার সাইড ব্যাগটা মাটি খুঁড়ে পুঁতে দিয়েছিল জোনাক-বাড়ির পেছনের জঙ্গলে।”
দীপমালাদেবী তাকিয়েছিলেন বিজনের দিকে। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামছিল! কোনওমতে বিজনের মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, “কেন এটা হল বিজু, কেন হল রে? কী ক্ষতি করেছিল লোকটা? আমি না হয় সরে আসতাম! আমি না হয়…”
“নয়নাদি!” মাথা নামিয়ে নিয়েছিলেন বিজন।
পুশকিন বুঝতে পারছিল না এসব কী হচ্ছে! কীসের গল্প শুনছে ও! কাজু, নয়না, ঝিকু এরা কারা?
বিজন বলেছিলেন, “তোমায় আর কাজুদাকে সেদিন আমাদের বাড়ির পেছনের বাগানে দেখে ফেলেছিল নয়নাদি। তুমি ওকে বলেছিলে না যে, কাজুদার সঙ্গে দেখা করতে যাবে। ও নিজেও এসেছিল অন্য পথে। আর দেখেছিল সব। বাজ পড়ছিল মনে আছে সেদিন? খুব ঝোড়ো আবহাওয়া ছিল। নয়না তোমাদের ছবি তুলেছিল। ওই বাজের আলো। আবছা কাঁপা ছবি… তারপর দেখিয়েছিল…”
“নয়না!” দীপমালাদেবী অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়েছিলেন, “কাকে?”
বিজন ঠোঁট কামড়ে সময় নিয়েছিলেন একটু। তারপর বলেছিল, “তোমার হাজ়ব্যান্ড এমনিতেই তো রেগে ছিল জুট মিল নিয়ে। তোমার শ্বশুরমশাইও। তার সঙ্গে এমন একটা ছবি! তাই…”