ডিনো কথা বলতে শুরু করাতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল মেয়েটা। আর পুশকিন দেখেছিল কী বিশাল চোখ তুলে ওর দিকে তাকাল জীবন!
পুশকিনের একটা অদ্ভুত ভাললাগা আসছিল হঠাৎ! এতদিন পরে আবার সব কিছু ভাল লাগছিল ওর। কেন কে জানে মনে হচ্ছিল জীবনের আসলে মানে আছে এখনও। এখনও কিছু ফুরিয়ে যায়নি। নতুন করে সত্যি যে শুরু করা যেতে পারে সেটা নিজের কাছে ক্রমশ আরও বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠছিল।
কিন্তু পাশাপাশি নিজেকে আটকাচ্ছিলও পুশকিন। কীসের জন্য এরকম মনে হচ্ছে, এই কারণটা কিছুতেই মনের মধ্যে আসতে দিতে চাইছিল না। কিন্তু আমাদের মন বড্ড একরোখা। গোঁয়ার। কিছুতেই সে লুকোনো জিনিসকে লুকিয়ে থাকতে দেয় না। ঘাড় ধরে বের করে আনে। তাই আইকা যেদিন রবীন্দ্র সদন মেট্রোর সামনে ওর সঙ্গে আবার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল নোঈর, সেদিনই পুশকিন বুঝেছিল জল বিপদসীমা পার করেছে!
কিন্তু ইচ্ছেই কি সব? আমাদের চাওয়াগুলোই কি সব? ওর জীবনের সঙ্গে এভাবে মিশলে নোঈর কোনও ক্ষতি হবে না তো! আর জয় বলে ছেলেটি ওর চেয়ে কমবয়সি। তাকে একসময় খুব ভালবাসত নোঈ। সে যদি আবার তমালের মতো ফিরে আসে? আবার ওকে যদি দেখতে হয় সেই ক্যাফের মতো দৃশ্য? তা হলে? ভয় হয় পুশকিনের। কষ্ট পেতে এখন বড় ভয় করে। তার চেয়ে একাই তো ভাল। নোঈ যদি ওকে কষ্ট দেয় সেটা আর ও নিতে পারবে না।
“আমি জানি আপনি আমায় খারাপ মেয়ে ভাবেন!” নোঈ গম্ভীরভাবে বলল।
পুশকিন অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল সামান্য। নোঈর কথায় ওর দিকে তাকাল।
নোঈ আবারও বলল, “আপনার মনে হয় যে, আমি জয়কে ভালবাসতাম সে এখন কী করে আপনাকে… কিন্তু মানুষ তো ভুল করে! আমি জানি স্মিতার ব্যাপারের পর আপনার পক্ষে কাউকে বিশ্বাস করা কঠিন। কিন্তু পুশকিনদা, আমায় ভরসা করা যেত। এভাবে না চলে গেলেও পারতেন।”
পুশকিন হাসল, “আমি কি নিজের ইচ্ছেয় চলে যাচ্ছি? আমার তো কাজ। বস বললেন তাই… আর তো কোনও কারণ নেই!”
“মিথ্যে কথা! এখানে এত কাজ এখন। আপনি একবার বললে বস আপনাকে বারণ করতেন? আপনি ইচ্ছে করে… সেদিন দুপুরে আমি নিজে থেকে আপনার কাছে এলাম বলে আপনি এমন করে চলে গেলেন!”
“না নোঈ! কী বলছ!” পুশকিন নোঈর হাতে হাত রাখল।
নোঈ হাতটা সরিয়ে নিল। রাগের গলায় বলল, “সোনাঝুরির এত কাজ কে সামলাবে এখন?”
“কেন? তুমি আছ, স্মরণ আছে। আর মেনলি তো কাগজপত্র। সেটা তো আমাদের ল ডিপার্টমেন্ট সামলে নেবে। তারপর প্রজেক্টের লোকজন চলে আসবে দিল্লি থেকে! এত টেনশন করছ কেন! প্লাস আমি তো আছি। স্কাইপ আছে। ডোন্ট ওয়ারি।”
“না আপনি নেই! আমায় ছেড়ে চলে গেছেন আপনি!” নোঈর গলায় অভিমান।
পুশকিন বলল, “ওরকম বলে না। কিছু হয়নি তেমন। আর তোমরা ঠিক পারবে। শুধু বিজনকাকুর সঙ্গে যোগাযোগ রেখো। ওদের নিয়ে যে বোর্ডটা তৈরি হয়েছে সেটার সঙ্গে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়।”
নোঈ মাথা নাড়ল, “আচ্ছা। বিজনবাবুর সঙ্গে আমি ঠিক যোগাযোগ রাখব। তবে আপনি নেই শুনলে খুব কষ্ট পাবেন। আপনার কথাতেই কিন্তু উনি গিয়েছিলেন দীপমালাদেবীর কাছে।”
কথাটা সত্যি। বিজনকে পুশকিন বুঝিয়েছিল যে, ওদের গ্রুপের কাজ শুধু ব্যাবসা করা নয়। পাবলিক ওয়েলফেয়ারও এদের একটা লক্ষ্য। বিজন ঠান্ডা মাথার মানুষ। সব শুনে রাজি হয়েছিলেন যেতে।
তবে নিজেরই যেন দ্বিধা ছিল। বলেছিলেন, “পরি বলল বটে, কিন্তু পেখমদি আমার কথা শুনবে?”
দীপমালাদেবীর সময় পেতে একটু অসুবিধে হয়েছিল। তাঁর সেক্রেটারি কিছুতেই সময় দিতে চাইছিল না। বলছিল, উনি আসছেন না। কী নাকি ব্যক্তিগত কাজে আটকে আছেন। কিন্তু পুশকিন অনেক বলে-কয়ে আধঘণ্টা মতো সময় বের করেছিল।
বিজন শেষমুহূর্তে একটু দোনোমনা করছিলেন। যাওয়ার দু’দিন আগে এক সকালে ফোনে বলেছিলেন, ওঁর খুব কাছের একটি ছেলের গুলি লেগেছে। ওঁর বাড়ির কাছেই। নিশান নাম। খবরটা শুনে চমকে গিয়েছিল পুশকিন। আরে, এ তো নোঈর কাজ়িন! ও সঙ্গে-সঙ্গে ফোন করেছিল নোঈকে। নোঈ বলেছিল, ও নাকি নার্সিং হোমেই আছে।
তবে নিশানের তেমন কিছু হয়নি। পেট ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে গুলি। আর পড়ে গিয়ে মাথা ফেটে গেছে। বাদল নামে ওরই এক বন্ধু নাকি গুলিটা করেছিল। ছেলেটা ধরা পড়েছে।
নোঈ সেদিন রাতে ফোন করেছিল ওকে। বলেছিল, “ওদের পার্টির মধ্যের গোলমাল। সবাই সন্দেহ করছে, তারক চক্রবর্তী এই কাণ্ডটা করিয়েছে। কিন্তু বাদল বলে যে ধরা পড়েছে, সে কিছু বলছে না! আর জানেন পুশকিনদা, কে বাঁচিয়েছে নিশানদাকে? মাহির। সেই লম্বা-চওড়া ছেলেটি। যে এসেছিল আমাদের কাছে। ও নাকি বিজনদার যাতে ক্ষতি না হয়, সেটা দেখার জন্য ওখানে ছিল। রিতুদা ওকে পাঠিয়েছিল। ভাবুন! কাকে বাঁচাতে গিয়ে কাকে বাঁচাল! আমার তো হাত-পা কাঁপছে এখনও! বাদল নাকি নিশানদার পুরনো বন্ধু। এই বন্ধু!”
বিজনকে পরের দিন ফোন করেছিল পুশকিন। আর অন্যদিকের কোনও কথা শোনার আগেই নিজে বলেছিল, “কাকু, যারা এমনটা করল, আপনি চান তারা আবার কোনও পার্টিকে ঢুকিয়ে দিক? দীপমালাদেবীর সঙ্গে আপনার দেখা হওয়া খুব দরকার। ওঁকে আপনি একটু বলুন। আমি ওঁর সময় নিয়ে নিয়েছি।”
কাঠের ঘর বলেই বোধহয় এই শীতেও গরম ছিল ঘরটা। স্মরণ আর নোঈকে ভেতরে নিয়ে যায়নি পুশকিন। বিজন আর ও শুধু গিয়েছিল।