কেমন একটা ঘোরের মধ্যে ছিল পুশকিন। যেন কুয়াশার কোনও শহরে চলে গিয়েছিল। আর তেমনই একটা আবছা রাতে আচমকা কী যেন পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়েছিল ও। কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। মাথা টলছিল। কিছু স্পষ্ট হচ্ছিল না পুশকিনের কাছে। মনে হয়েছিল সত্যি কিছু শুনেছিল কি? মনের ভুল নয় তো? তাই সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে ও ঘুমিয়ে পড়েছিল আবার।
তারপর অনেক রাতে ঘুম ভেঙেছিল। নেশা কাটলেও টলমল করছিল মাথা। মনে হচ্ছিল নৌকোয় ভেসে আছে যেন। ও কোনওরকমে ঘর থেকে বেরিয়েছিল বাথরুম যাবে বলে। আর তখনই দেখেছিল ব্যাপারটা।
দেখেছিল, রান্নাঘরের সামনে পড়ে আছে স্মিতা। মুখ-চোখ নীল! স্থির! এটা কী হল? ও প্রায় দৌড়ে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসেছিল স্মিতার সামনে। স্মিতার ঠোঁটে পাঁউরুটির গুঁড়ো লেগে ছিল। পাশে পড়েছিল আধখাওয়া একটা রুটি।
কী হয়েছে বুঝতে পারছিল না পুশকিন। ও দ্রুত মোবাইল নিয়ে ওয়ান ওয়ান টু নম্বরে ডায়াল করেছিল। মেডিক্যাল সার্ভিস চেয়েছিল। আর, কী করবে বুঝতে পারছিল না। সাধ্যমতো স্মিতার গলার কাছে, হাতে, পালস পাওয়ার চেষ্টা করছিল। কিন্তু পাচ্ছিল না। কেমন একটা লাগছিল পুশকিনের। কী হল এটা? ও এদিক-ওদিক দেখছিল। কী খেল স্মিতা? কী করে হল এমন? আর তখনই চোখ পড়েছিল একটা আধখোলা কৌটোয়। গায়ে কোনও লেবেল নেই। ও দ্রুত ভেতরের আঠালো জিনিসটা আঙুলে তুলে মুখে দিয়েছিল। পি নাট বাটার। পাশেই আর-একটা প্যাকেট খোলা ছিল। প্রন চিপ্স। আরে, বাদাম আর চিংড়িতে তো স্মিতার ভয়ংকর অ্যালার্জি! ও এ দুটো খেয়েছে কেন? ও তো জানত এটা খেলে খুব শরীর খারাপ করে! তা হলে? লেবেল ছিল না বলে বুঝতে পারেনি! স্মিতার অ্যালার্জি হলে শরীরের ভেতরে হয়! বাইরে বিশেষ লক্ষণ দেখা যায় না! আর এই ব্যাপারটা যে মারাত্মক, সেটা তো ডাক্তার বলে দিয়েছিল বারবার!
ইমার্জেন্সি মেডিকাল সার্ভিসের লোকজন এসেছিল। ওরা বের করে নিয়ে যাচ্ছিল স্মিতাকে। পুশকিন কী করবে বুঝতে পারছিল না! ওকে ওরা প্রশ্ন করছিল নানারকম। কী হয়েছে? কী করে হয়েছে? সব জানতে চাইছিল। কিন্তু স্পষ্ট করে উত্তর দিতে পারছিল না পুশকিন। ওরাও বুঝতে পারছিল যে, ও সুস্থ নেই!
অ্যাম্বুলেন্সে বসে স্মিতার দিকে তাকিয়েছিল পুশকিন। নিথর দেহ! ওরা নানারকমভাবে চেষ্টা করছিল। কিন্তু স্মিতার সাড় ছিল না কোনও। হাতটা কেমন ঠান্ডা। মুখটা নীলচে। পুশকিনের চোখ ঝাপসা হয়ে গেছিল। কী করল এটা স্মিতা! ও কি বুঝতে পারেনি? ও কি নিজেও মানসিক চাপে এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল? পুশকিন কি দায়ী এর জন্য? সেই শব্দটা তা হলে সত্যি শুনেছিল! সেটা তা হলে স্মিতার পড়ে যাওয়ার শব্দ ছিল! স্মিতা তো ওর ঘরে আসত না। কিন্তু ওই অবস্থায় একবারও কি ওকে বলতে পারত না যে, শরীর খারাপ লাগছে! কেন এমন করল স্মিতা? কীসের জন্য এমনটা হল? পুশকিন কেন শব্দটা শুনে বেরিয়ে গেল না একবার?
পুশকিন গাড়ির মেঝের মধ্যে বসে স্মিতার হাতে মুখ গুঁজে দিয়েছিল। দু’সপ্তাহের জমে থাকা কান্না যেন সব বেরিয়ে আসছিল হু হু করে। নিজেকে আটকাতে পারছিল না পুশকিন। গাড়িতে থাকা প্যারামেডিকরা ওকে জাপটে ধরে সরিয়ে নিতে চাইছিল। কিন্তু পুশকিন কিছুতেই ছাড়ছিল না স্মিতার হাত। মনের মধ্যে ভেসে আসছিল সেই প্রথম দিন বেঞ্চে বসে থাকা স্মিতা! একসঙ্গে বাড়ি ফেরা স্মিতা! সেই ভারী বৃষ্টির মধ্যে গাড়ির মধ্যে ওর পাশে বসে থাকা স্মিতা! যার জন্য সব ছাড়ল, সে যদি এমন করে চলে যায় তা হলে আর কী থাকে মানুষের? নিজেকে শূন্য, একাকী আর ভাঙা মনে হচ্ছিল ওর।
স্মিতা যে মারা গেছে, সেটা মেনে নিতে অনেকদিন লেগেছিল পুশকিনের! চাকরিটাও ছেড়ে দিয়েছিল। কারও সঙ্গে মিশত না। কথা বলত না। যোগাযোগ রাখত না। কেমন একটা একলা মানুষ হয়ে গিয়েছিল ও। শুধু মনে হত, ওর জন্যই কি মারা গেল স্মিতা! ও-ই কি মেরে ফেলল মেয়েটাকে? যে ওর সঙ্গে থেকে খুশি নয়, তাকে তো ছেড়ে দেওয়াই ভাল। কিন্তু ও অমন ব্যবহার করেছিল বলেই কি স্মিতা মেনে নিতে পারেনি? কিছু বুঝত না পুশকিন। মাথা পুরো সাদা হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে মনে হত মরুভূমির মাঝে দাঁড়িয়ে রয়েছে একা।
পাক্কা এক বছর এমন একলা হয়ে ছিল পুশকিন। তারপর ধীরে-ধীরে নিজেকে সামলেছিল। নিজের দিকে তাকিয়েছিল। কাজ খুঁজে, ইন্টারভিউ দিয়ে আবার চাকরি পেয়েছিল একটা। বিদেশের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে এসেছিল। আবার নতুন করে জীবনে ফিরে আসার চেষ্টা করেছিল।
বাবা আর ভাইও ক্রমে ওকে নিজেদের জীবনে মেনে নিতে, ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছিল। ছেড়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সংসারের লোকজন আবার কাছে আসতে শুরু করেছিল। ধীরে হলেও সময় কাটছিল। আর তারপর গতবছর ফেব্রুয়ারিতে আমেরিকা থেকে এসেছিল ওর ভাই। দীনবন্ধু। তার মেয়ে দেখতে যাওয়ার কথা হয়েছিল। বাবা জোর করেই পুশকিনকে পাঠিয়েছিল ডিনোর সঙ্গে। পুশকিনের ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু, তাও গেছিল ও। ভেবেছিল, অনেক নিজের ইচ্ছেয় চলা হয়েছে। আর নয়। ওর মনে হয়েছিল এবার অন্যদের কথাও কিছু শোনা উচিত।
তবে বাবার কথা শোনাটা খারাপ কিছু হয়নি। ডিনোর জন্য পাত্রী দেখতে গিয়ে থমকে গিয়েছিল পুশকিন। নোঈ এসে বসেছিল ওদের সামনে। গম্ভীর মুখ। মাথা নিচু। দেখেই বোঝা যাচ্ছিল এভাবে এসে বসতে হচ্ছে বলে মোটেও খুশি নয়।