আজ সন্ধের ফ্লাইটে দিল্লি যাচ্ছে পুশকিন। তারপর সেখান থেকে কাল বুদাপেস্ট। হাঙ্গেরির এক অদ্ভুত সুন্দর শহর। সেখানে দু’বছরের জন্য চলে যেতে হচ্ছে পুশকিনকে।
স্মরণ পেছন ফিরে বলল, “ডায়েরিটার সব লেখা আর পড়ার মতো নেই। কিন্তু চার-পাঁচটা পাতা যা পড়া যাচ্ছে, তার মধ্যে এটা আমার বেশ লেগেছে। তাই না রে নোঈ?”
পুশকিন কিছু না বলে হাসল। দেখল পাশে বসা নোঈর মুখ থমথমে। স্মরণের কথাটা যেন শুনলই না!
স্মরণ বুঝল, ওর এখন কথা বলা বিশেষ ঠিক হবে না। ও সামনে ঘুরে নিজের মনে শুধু বলল, “যাঃ শালা! সব মেয়েই কেমন প্যাঁওয়ের মতো হয়ে যাচ্ছে!” তারপর কোলে রাখা ব্যাগ থেকে একটা ইয়ারফোন বের করে মোবাইলের সঙ্গে লাগিয়ে কানে গুঁজে নিল।
পুশকিন আলতো করে নোঈর হাতটা ধরল এবার। নোঈ তাকাল মুখ তুলে। ফরসা মুখটা গোলাপি হয়ে আছে। চোখ দুটো বেশ লাল।
পুশকিন আলতো গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এমন মুখ করে আছ কেন?”
নোঈ কিছু না বলে তাকিয়েই রইল।
পুশকিন হাসল, “কী পাগলি দ্যাখো! এমন কেউ করে? কিছু তো বলো! সেই বাড়ি থেকে বেরোনোর পর একটাও কথা বলোনি! কী হয়েছে?”
নোঈ মাথা নামিয়ে নিয়ে বলল, “আমি কী আর বলব! আপনি তো ছেড়েই চলে যাচ্ছেন! দু’বছরের জন্য। তা হলে? আর কিছু কি বলার থাকতে পারে? আমি জানি লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ টেকে না। আমার তাই কিছু বলার নেই।”
পুশকিন হাসল।
“আপনি হাসছেন?” নোঈ আহত চোখে তাকাল ওর দিকে, “আপনার কাছে হয়তো সহজ এটা, কিন্তু আমার কাছে মোটেও সহজ নয়।”
পুশকিন নোঈর হাতে অল্প চাপ দিল। তারপর বলল, “দেখাই যাক না কী হয়।”
নোঈ চোয়াল শক্ত করে বলল, “কী দেখার আছে এর মধ্যে! আপনি চলে গেছেন আমাকে ছেড়ে। এন্ড অফ স্টোরি।”
পুশকিন মাথা নামিয়ে নিল। নোঈকে কী বলবে ও? আর তো বলার কিছু বাকি নেই। সব তো জানা-বোঝা হয়ে গেছে।
“আর শুনুন,” নোঈ আবার ডাকল।
পুশকিন মুখ তুলে তাকাল আবার।
“ওই ব্যাপারে আপনার কোনও দোষ নেই। ছিলও না। আর নেইও! শুধু-শুধু নিজেকে আর টরমেন্ট করবেন না!”
পুশকিন হাসল। স্মিতার ব্যাপারে ওর দোষ ছিল কি ছিল না, সেটা নিয়ে আজও ওর সংশয় আছে। এটা কাউকে বলেনি আজ পর্যন্ত। কিন্তু নোঈকে বলেছে! নোঈকে সব কিছু বলতে পারে ও!
বাড়ির অমতে স্মিতাকে বিয়ে করেছিল পুশকিন। বাড়ি থেকে একরকম বের করেই দেওয়া হয়েছিল ওকে। তবে তাতে কষ্ট পেলেও ভেঙে পড়েনি পুশকিন। মা মারা যাওয়ার কিছু সময় পরে চাকরি নিয়ে প্যারিস চলে গিয়েছিল ও। স্মিতার সঙ্গে কী ভাল কেটে ছিল প্রথম দুটো বছর। তারপর কাজের চাপ বাড়তে লাগল। স্মিতার সঙ্গে সময় কাটানোটা কমতে লাগল একটু-একটু করে। আর জীবনের ঠিক এই জায়গায় স্মিতার সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল তমালের।
স্মিতা যে ওর কাছ থেকে দূরে সরে যেতে শুরু করেছে, সেটা কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছিল পুশকিন। ফোন সারাক্ষণ কানে। সব সময় অন্যমনস্ক। কাছে আসতে চাইছে না। খিটখিট করছে।
পুশকিন তাই সোজা একদিন ধরেছিল ওকে। জিজ্ঞেস করেছিল, কী এমন হয়েছে যে স্মিতা এমন করছে? কিন্তু উত্তর পায়নি। কথা কাটিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল স্মিতা। বলেছিল না, কিছুই হয়নি। সবই ঠিক আছে।
মিথ্যের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, বেশিদিন চাপা থাকে না। এটাও থাকেনি। এক শুক্রবার অফিস ফেরার পথে তমাল আর স্মিতাকে একটা রোড সাইড ক্যাফেতে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিল পুশকিন। সারা পৃথিবী ভুলে দু’জন দু’জনকে আঁকড়ে ধরে চুমু খাচ্ছিল!
পুশকিন নড়তে পারেনি। বিশ্বাস করতে পারেনি। এটা কী দেখছে ও চোখের সামনে? এটা সত্যি স্মিতা তো? আর তমাল এখানে কী করছে! স্মিতাই বিয়ের আগে ওকে তমালের ছবি দেখিয়েছিল। তাই তমালকে চিনতে ওর অসুবিধে হয়নি।
পুশকিন কী করবে বুঝতে পারছিল না। বিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল ওদের সামনে। স্মিতা চুম্বনের আবেশে প্রথমে বুঝতে পারেনি ব্যাপারটা। তারপর পুশকিনকে চিনতে পেরে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। তমালও উঠে দাঁড়িয়েছিল স্মিতার পাশ থেকে। তারপর আর একমুহূর্ত অপেক্ষা না করে প্রায় দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিল ওখান থেকে।
স্মিতা কী বলবে বুঝতে পারছিল না। থরথর করে কাঁপছিল শুধু। মুখ-চোখ লাল হয়ে গেছিল। ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে আর কিছুই বলতে পারছিল না।
পুশকিন শুধু বলেছিল, “তোমায় এই অবস্থায় রেখে ও দৌড়ে চলে গেল! পালিয়ে গেল!”
পরের দু’সপ্তাহ কী করে কেটেছিল, সেটা আর স্পষ্ট মনেও নেই পুশকিনের। সব কেমন ঘষা কাচ দিয়ে ঢাকা যেন। পুশকিন অফিস যায়নি। কারও ফোন ধরেনি। কিছু করেনি। শুধু নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্ধ করে রেখে মদ খেয়ে গেছিল। সারা জীবন যে-মানুষটা মাত্র দুই বা তিনবার মদ ছুঁয়েছিল, সে ওই দু’সপ্তাহের গোটাটাই ডুবেছিল অ্যালকোহলে। স্মিতা কিছু বলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু শোনেনি পুশকিন, কিচ্ছু শোনেনি।
ও তো সরেই গেছিল। সামনেও তো যায়নি। তা হলে কেন ওকে জোর করে নিজের জীবনে নিয়ে এসেছিল স্মিতা! ও স্মিতার জন্য সব ছেড়েছে। কারও কথার কোনও গুরুত্ব দেয়নি। সেখানে স্মিতা এটা করতে পারল? এই কি প্রেম? এই ভালবাসা? মানুষ কেন অন্যের ইমোশন নিয়ে, জীবন নিয়ে খেলে? কী পায় খেলে? বাবা মায়েরা কি এদের ছোটবেলায় পুতুল কিনে দেয়নি, খেলনা কিনে দেয়নি যে, বড় হয়ে মানুষকে নিয়ে খেলে সেই অভাব পূর্ণ করতে হবে?