বৃষ্টি নেমে আসছে দ্রুত। সামনে আবছায়ায় কারা যেন ধস্তাধস্তি করছে! যন্ত্রণাটা বাড়ছে। ছড়িয়ে পড়ছে সারা শরীরে। আর শরীর নিভে আসছে ক্রমশ। অন্ধকার নেমে আসছে… কাছে কীসের যেন শব্দ। কে যেন চিৎকার করল… ধাতুতে ঘষা খেল ধাতু। আর সব কিছু নিভে এল ক্রমশ। শুধু বৃষ্টির ফোঁটা ঝরে পড়তে লাগল। একাকী বিরামহীন বৃষ্টি।
তারপর আবার চোখ মেলল নিশান। কোথায় ও! কতক্ষণ কেটে গেছে!
আলো-আলো অন্ধকার। অন্ধকার-অন্ধকার আলো। ঝাপসা চৌকো আলো। সরে-সরে যাচ্ছে… মাথার ওপর দিয়ে সরে যাচ্ছে মেঘলা একটা করিডরের ছাদ। ঠান্ডা। আর কী গরম! অন্ধকার অন্ধকার যন্ত্রণা। অবশ হয়ে যাওয়া দৃষ্টি। কোথায় যাচ্ছে নিশান! কোথায় এখন ও! চোখ বুজে আসছে। মাথা ফাঁকা। শুধু দূর আকাশে যেন চিল উড়ছে একটা। আকাশ-আকাশ আলো। কারা ঝুঁকে পড়ছে সেই আকাশ থেকে? কাদের মুখ এগুলো? ফোঁটা ফোঁটা মুখ। চেনা লাগছে। তাও মনে পড়ছে না। চোখ বুজে আসছে নিশানের। ক্লান্ত লাগছে। অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সিঁড়ি নেমে গিয়েছে যেন। ডাকছে, সিঁড়িগুলো ডাকছে নিশানকে। ওকে যেতে হবে। দূরে যেতে হবে। একা। নিশান সিঁড়িতে পা রাখল এবার। আর, কে যেন ডাকল পেছনে! মুখ তুলে দেখল নিশান। মা! মা এসে দাঁড়িয়েছে! অন্ধকারে ছোট্ট আলোর মতো মা! কী বলছ তুমি, মা?
“বাবু, বাবু!” মা ডাকছে? ছোটবেলা থেকে মা ডাকছে ওকে? উঠোনের পেয়ারা গাছের পাশে এসে পড়েছে কত রোদ! আর নিশান ঘুরছে সেই রোদে। ছোট্ট লাল সাইকেল। ও ঘুরছে। আর মা আচারের বয়াম দিচ্ছে রোদে। ওদের ছোট্ট কুকুরটা ঘুরছে সাইকেলের পেছনে। আর মা ডাকছে ওকে। খেতে ডাকছে। দূরে গান বাজছে একটা। কিশোর কুমারের গান। ভগবান নাপিত এসে বসে পড়েছে দাদুর চুল কাটতে। আর বাবা বাজার হাতে ঢুকছে। কোথায় বাবা? তুমি কোথায় ছিলে? আর মা? কই মা? রোদের বয়াম পড়ে আছে। পেয়ারা গাছের পাশে কুচি-কুচি রোদ পড়ে আছে। আর তুমি মা, তুমি কোথায় গেলে? মা… সাইকেল থেকে উঠে পড়ছে নিশান…
আর কারা যেন হাত ধরল ওর। শুইয়ে দিল। আলো-আলো অন্ধকার। মাথার ওপর চৌকো আলোর কাটাকুটি। কোথায় এসেছে ও? এখানে মা আছে? মা… আবার সেই সব কিছু মুড়ে দিল অন্ধকার!
“বাবু, বাবু,” নিশান চোখ খুলল এবার। কে ডাকছে? আলো এসে লাগছে চোখে। কে এসে দাঁড়িয়েছে? চোখ কুঁচকে তাকাল নিশান। আঃ, মাথায় লাগছে। চোখে লাগছে খুব। নিশান চোখ বন্ধ করে নিল আবার।
কে যেন হাত দিল মাথায়। এবার আস্তে-আস্তে চোখ খুলল নিশান। সকালের রোদ এসে পড়ছে ঘরে। মানুষের মাথার ধূসর সোনালি আউট লাইন দেখা যাচ্ছে। এবার ভাল করে দেখল। ও নার্সিং হোমে। মা দাঁড়িয়ে আছে মাথার কাছে। বাবাও আছে পাশে। আর… আর ওই তো বিজনদা, কেয়াদি। আরে মণীশ, নোঈও এসেছে! পাশে কে? সেই অদ্ভুত চুলের স্মরণ না? আর সেই লম্বা ছেলেটা! সেও! সে কী করে এখানে এল! কী যেন নাম! কোথায় যেন দেখেছিল… সেই… সেই রেস্তরাঁ! মাহির!
আর ও… ও কোথায়? নিশান মুখ ঘোরাল। আর দেখল মায়ের পেছনে চেয়ারে বসে রয়েছে রাধিয়া। চুল অবিন্যস্ত। চোখ লাল।
নিশান হাসার চেষ্টা করল। পারল না। মাথায় লাগছে! পেটেও কী ব্যথা! যন্ত্রণা! ঘুম আসছে ওর। ক্লান্ত লাগছে। ও মাথা ঘোরাল। দেখল বাবা গিয়ে মাথায় হাত দিয়েছে রাধিয়ার! মা ধরে আছে রাধিয়ার একটা হাত! এসব কার জীবন? কার সংসার? ওর? এরা ওর লোক! চোখ বুজে আসছে নিশানের। মাথা নিভে আসছে আবার। কিন্তু অদ্ভুত একটা আনন্দ হচ্ছে ওর। এসব কি সত্যি? ওরা কি সত্যি এসেছে? নাকি স্বপ্ন দেখছে! নিশান আবার চোখ খোলার চেষ্টা করল। কী আলো! ব্যথা লাগছে চোখে! বাবা? বাবা কই! এই তো ছিল রাধিয়ার পাশে! কিন্তু এখন? এখন কই? তবে কি স্বপ্ন দেখছে নিশান! ভাল একটা পৃথিবীর স্বপ্ন! সবাই মিলে বেঁচে থাকার পৃথিবীর একটা স্বপ্ন!
নিশান চোখ বন্ধ করে মাথাটা পাশ ফেরাল আবার। তারপর ঘুমের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল অনেক দূরের একটা উঠোনে। দেখল, পেয়ারা গাছের পাশে রোদ এসে পড়েছে আবার। আবার মা আচারের বয়াম রাখছে রোদে। বাবা এই বাজার নিয়ে ঢুকল। আর ভীষণ ট্যারা ভগবান নাপিত দাদুর চুল কাটছে বসে। ঘুমের মধ্যে সামান্য হাসল নিশান। তারপর এগিয়ে গেল মায়ের কাছে।
মা ঘুমন্ত নিশানের দিকে তাকিয়ে আলতো গলায় সবাইকে বলল, “তোমরা চলো এখন। ও ঘুমোক। রাধিয়া, তুমি এখানে থাকো শুধু। কেমন?”
৪০. পুশকিন
অন্য কোনও নদীর পাশে দাঁড়িয়ে ওঠে ঘুম
গাছের পাতায় শেষ হল প্রায় বাদামি মরসুম
কাঁধের ঝোলা, রুপোর লকেট, ফেরত আসা খাম
শূন্য আমার বুকপকেটে তোমাকে রাখলাম
তুমিও রেখো আমার তারা, নৌকোবেলার ছই
এই জন্মের অনেক আগেই আমরা কিছু হই
ভাবতে আমার ভালই লাগে! ভাবতে জীবন শেষ…
তোমার থেকে দূরের বলেই, দিন যেন দরবেশ
ভিক্ষে আমার রাজার মোহর, অন্ন সোনার ক্ষীর!
আমার হয়ে তোমার কাছে থাকুক জোনাকি…
গাড়ির সামনে বসে স্মরণ গোটা লেখাটা সময় ধরে বলে গেল।
বিকেল নামছে এখন। বাইপাসে গাড়িরা হু হু করে এগিয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিনের ডিপ্রেশনের পরে, আকাশ ভরে রোদ উঠেছে কলকাতায়। ঠান্ডাটাও পড়েছে তার সঙ্গে। নতুন বছরের উৎসবের আমেজ শহরের চোখে-মুখে লেগে রয়েছে এখনও! আর, এই সময়ে ওকে কলকাতা ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে! পুশকিনের হাসি পেল। জীবন এক অদ্ভুত জার্নি! যখনই ওর মনে হয়েছে যে, গন্তব্য পেয়ে গিয়েছে তখনই জীবন এক মোচড়ে সব উলটে-পালটে দিয়েছে। আবার এমন জায়গায় এনে ফেলেছে যেখান থেকে নতুন করে জীবন শুরু করতে হয়েছে ওকে।