“কিন্তু যদি না হয়?” নিশান ভুরু কুঁচকে বলল।
“এটা তোর যুক্তি তো? আচ্ছা, কয়েকদিন পরে আমি যাব মালিকদের ওখানে। তুইও চল। নিজে দেখে বুঝে নে। কিন্তু গোঁয়ারতুমি করিস না! সব কিছু পালটায় নিশান। আজ ধর ওরা চলে গেল। তারপর যদি সামনের বছর মিল বন্ধ হয়ে যায়, দেখবি আজ তোর কথায় যারা নাচছে, তারাই তখন তোকে গালি দেবে! এটা একবার ভাব। রাজনীতি মানে কিন্তু এখনকার কথা নয় শুধু, ভবিষ্যৎ দেখতে না শিখলে কিছু হবে না।”
নিশান মাথা হেঁট করে বসে রইল।
বিজনদা চৌকি থেকে উঠে এসে ওর পাশে দাঁড়াল, “আমি জানি এতদিন পরে হঠাৎ যদি তুই উলটো কথা বলিস ওরা ভাববে, তোর কোনও ভেস্টেড ইন্টারেস্ট আছে। তাই বলছি ওদের মধ্য থেকেও কেউ-কেউ চলুক। আমি যেটা তোকে বললাম, তুই সেটা বল ওদের। সব খোলাখুলি হোক। আমি কি তারক নাকি যে, টাকা খাব এই জন্য!”
“না না, তা বলিনি বিজনদা!” নিশান বিজনদার হাতটা ধরল।
“শোন তোকে হ্যাঁ-না করতে হবে না, তুই একবার চল আমার সঙ্গে। তোর সঙ্গে যারা আছে তাদেরও কেউ যাক। ব্যাপারটা বোঝ। জেদ করে থাকিস না।”
নিশান উঠে দাঁড়াল। তারপর বলল, “আমি একটু ভাবি বিজনদা। মানে, সত্যি ভাবি। যারা আছে তাদেরও বলি। দেখা যাক তারা কী বলে।”
বিজনদা বলল, “দরকার হলে তাদের আমার কাছে নিয়ে আসবি। কিন্তু এভাবে সব বন্ধ করে দিস না। দরজা-জানলা খোলা রাখবি নিশান। ওটা ইমপর্ট্যান্ট। বুঝলি!”
নিশান হাসল। বিজনদার কথাগুলো খারাপ লাগছে না ওর। কিন্তু এটাও সত্যি যে, ও একার হাতে কিছু করতে পারবে না। দেখা যাক, কী হয়!
বারান্দায় এসে ও রেনকোটটা পরল আবার। তারপর খুব শিগগিরি জানাবে বলে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ল।
বৃষ্টি কমেছে। কিন্তু একেবারে থেমে যায়নি। আবার বড়রাস্তার দিকে হাঁটা দিল নিশান। সাড়ে দশটা বাজে প্রায়। রাস্তায় লোক দেখতে পাচ্ছে না। পাশে ভাঙা রেল লাইনের মাঝে বেশ জল জমে গিয়েছে। ও সরু রাস্তা দিয়ে এগোতে লাগল। মা খুব রাগ করছে নিশ্চয়। বাবাও এসে গেছে এতক্ষণে। হঠাৎ বাবা-মায়ের জন্য খারাপ লাগল নিশানের। সত্যি ও বাড়িতে সময় দেয় না। এটা ঠিক নয়। বিজনদার কথাটা শুনে বুঝল যে, এটা কাল সকালে শুনলেও চলত। আসলে বিজনদার বয়স হয়েছে, তাই হয়তো আজকাল সবকিছুতেই একটা তাড়া লাগায়। বয়স হলে কি মানুষ এমন হয়ে যায়? আচ্ছা, নিশানও কি এমন হয়ে যাবে? রাধিয়া কেমন হবে?
রাধিয়ার কথা মাথায় আসতেই মনটা ভাল হয়ে গেল নিশানের। মেয়েটা সত্যি ভালবাসে ওকে! সত্যি…
“নিশান!” পেছন থেকে কে যেন ডাকল।
নিশান দাঁড়িয়ে পড়ল। ঘুরে তাকাল পেছনে। চেনা গলা। কে ডাকছে এই অন্ধকারে!
“নিশান!”
লোকটা কাছে আসতে বুঝতে পারল নিশান। আরে বাদল! ও এখন এখানে কী করছে?
“তুই!” নিশান অবাক হল।
“হ্যাঁ রে আমি!”
নিশানের নাক কুঁচকে গেল। বাদলের মুখ থেকে তীব্র মদের গন্ধ বেরোচ্ছে!
“কী বল? কী হয়েছে তোর?” নিশান অবাক হল।
বাদল এসে দাঁড়াল সামনে। আর ঠিক তখনই বৃষ্টিটা জোরে নামল আবার। নিশান আকাশের দিকে তাকাল। নিকষ কালো একটা অন্ধকার কড়াই যেন উলটে আছে মাথার ওপরে!
বাদল জড়ানো গলায় বলল, “আজ তোদের দেখলাম। তোকে আর মালিকের মেয়েকে। হেভি মাল তুলেছিস! ব্যাপক! তা লাগিয়েছিস নাকি এর মধ্যে?”
“কী বলছিস তুই?” নিশান চোয়াল শক্ত করল।
“আমি বললে দোষ হয়ে গেল?” বাদল আর-একটু কাছে এল, “তারকদা বলেছিল, মালটাকে নজরে রাখবি। দেখলাম, শালা লক্কা পায়রা হয়ে আকাশে লাট খাচ্ছে! আর… আর মাঝখান থেকে আমার বোনটাকে… শুয়োরের বাচ্চা…”
“কী বললি? মেঘলাকে আমি কী?” নিশানের মাথায় আগুন লেগে গেল।
“শালা, আমার বোনকে ধরিসনি তুই? চুমু খাসনি? হারামি মাগিবাজ শালা!”
“তবে রে…” নিশান আর মাথার ঠিক রাখতে পারল না। আচমকা এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিল বাদলের গালে।
“আমার গায়ে হাত দিলি! আমার বোনকে খেয়ে এখন… শালা, তারকদা ঠিক বলেছে। তোর শালা বাঁচার অধিকার নেই! সব তোর বাপের সম্পত্তি, না? আজ তুই গেছিস!” আচমকা দু’পা পিছিয়ে গেল বাদল। তারপর কোমর থেকে কালোমতো কী একটা বের করল। অন্ধকারে চোখ সয়ে যাওয়ায় এবার জিনিসটা দেখতে পেল নিশান। একটা ওয়ান শটার পিস্তল!
“কী করছিস বাদল! ওটা ঢোকা!” নিশান চিৎকার করে উঠল। কিন্তু ভারী বৃষ্টির তলায় চাপা পড়ে গেল ওর গলার আওয়াজ।
“আমার বোন কেঁদেছে! তোর জন্য কেঁদেছে! তারকদা ঠিক বলেছে, দে শালাকে ঠুকে! শালা, আজ তুই গেলি! আজ…”
কথা শেষ করতে পারল না বাদল, আচমকা পেছন থেকে একটা ভারী পায়ের শব্দ এল দ্রুত। বাদল ঘাবড়ে গেল বেশ। ও পেছনে ফেরার আগেই অন্ধকার থেকে কেউ একটা ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপরে! আচমকা ধাক্কায় পড়ে যেতে-যেতে শেষমুহূর্তে বাদল ওয়ান শটারের ট্রিগারটা টিপে দিল।
চাপা, টায়ার ফাটার মতো শব্দ হল একটা। আর কেমন যেন ধাক্কা লাগল নিশানের। ও টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। লোহার রেল লাইনের একটা কোণ ভোঁতা শব্দ করে লাগল মাথার পাশে। নিশানের মনে হল কেউ যেন দু’হাত দিয়ে টেনে ওর মাথা আর শরীরটা আলাদা করে দিতে চাইল! ও চোখ মেলে দেখতে চাইল। কিন্তু পারল না। পেটে কী অসহ্য যন্ত্রণা!