তারক কেমন যেন হঠাৎ চুপ করে গেল। আর বাকি পথটা কিছু বলল না। নিশান বুঝল ওর কথাটা একদম মোক্ষম জায়গায় গিয়ে লেগেছে!
গাড়িটা ওকে নামিয়ে দিল ভাঙা রেললাইনের কাছে। এদিকটা আরও নির্জন। কেমন একটা ছমছমে ভাব আছে। লাইনটা দিয়ে অনেক আগে জুটমিলে কাঁচা মাল নিয়ে আসত গুডস ট্রেন। কিন্তু দীর্ঘদিন আর মালগাড়ি না চলায় ভেঙে গেছে জায়গায় জায়গায়। লাইনের পাশে সরু রাস্তা। সামান্য নোংরা। ঝোপঝাড় পাশ থেকে এসে রাস্তাটাকে আরও সরু করে দিয়েছে।
পার্টি অফিসে ঢোকার সামনে বড় চওড়া রাস্তা আছে। কিন্তু বিজনদার বাড়িটা যেহেতু পার্টি অফিসের পেছন দিকে, তাই এই পথেই যেতে হয়।
রাস্তাটা চেনা নিশানের। তাই অন্ধকার হলেও খুব কিছু অসুবিধে হল না। সামান্য দূরে বিজনদার বাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে।
দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ল নিশান। একটু সময় নিয়ে বিজনদা দরজা খুলে দিল। নিশান ঘরের সামনের বারান্দায় ঢুকে একপাশে সরে দাঁড়াল। সারা শরীর দিয়ে জল ঝরছে। ও দ্রুত রেনকোটটা খুলে বারান্দার পাশের তারে ঝুলিয়ে দিল। দেখল, বিজনদা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে ফোনে। তারই মধ্যে ওকে হাত দিয়ে ঘরে আসতে ইশারা করল বিজনদা।
নিশান ঘরে ঢুকে একটা টুলে বসল। রেনকোট থাকলেও সামান্য জল চুঁইয়ে ঢুকেছে ভেতরে। প্যান্টের নীচ আর কলারের কাছটা ভিজেছে একটু। বিজনদা এসে বসল সামনে চৌকিতে। শুনল ফোনে বলছে, “হ্যাঁ, গলায় মাফলার আছে। পায়ে মোজাও পরেছি। না, না, চোখের ওষুধ ফুরোয়নি, আছে এখনও। আর তেলেভাজা রোজ খাচ্ছি না বাবা! আরে, বিরক্ত হলাম কোথায়! কী বলে! না, না, বিরক্ত হইনি। কী মুশকিল… এমনি মানে… আরে, এত রাগ করো কেন! শরীর এখনও উইক কিন্তু। এভাবে কেউ ফোনে চেঁচায়! মানে… চেঁচায়! মানে কথা বলে! সব উলটো ধরো কেন? আর রাতে রুটি আর ফুলকপির তরকারি করেছি। না, না, তোমায় পাঠাতে হবে না কিছু! মাঝে মাঝেই তো পাঠাও। কী বিপদ! আমি সত্যি বলছি! আর শোনো, নিশান এসেছে। একটু কাজ আছে ওর সঙ্গে। পরে তোমায় আবার কল করব। মানে, হ্যাঁ, তুমিই তো করো, আমি তো বিশেষ কল করি না… ঠিক আছে বাবা, তুমিই কোরো। এখন রাখি। কেমন?”
ছোট্ট ফোনটা কেটে সামনে থাকা বালিশের তলায় রেখে মাথা নাড়ল বিজনদা। হাসল নিজের মনে, “পাগলি!”
“কেয়াদি?” নিশানও হাসল।
“আর কে! এখনও একই রকম আছে! কে বলবে বয়স হয়েছে!” বিজনদা হাসল।
নিশান মাথা নাড়ল নিজের মনে। দেখল, বিজনদার গলায় মাফলার নেই, পায়েও মোজা নেই।
বিজনদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “সারা জীবন পাগলামি করে গেল। আমায় ভালবাসত। কিন্তু সব ছেড়ে আমায় ওকে নিয়ে নাকি বিদেশে যেতে হবে! সেটা করলাম না বলে রাগে দুম করে অন্যকে বিয়ে করে নিল! নিজের জীবনটা নিয়ে কীসব করল! ও পাগলি, ওকে কেউ বুঝতে পারবে ও ভেবেছিল? সেদিন নার্সিং হোমে ও কাঁদছিল। তোরা তো কেউ ছিলি না। আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখি কান্না বেড়ে গেল আরও! আমার এত কষ্ট লাগছিল!”
নিশান তাকাল বিজনদার দিকে। তারপর চোখ বুলিয়ে ঘরটাকে দেখল। খুব ছিমছাম ঘর। একটা আলমারি। একটা আলনা। কাঠের একটা চেয়ার-টেবিল আর এই চৌকি। ব্যস।
ও জিজ্ঞেস করল, “এই জন্য তুমি বিয়ে করলে না বিজনদা?”
বিজন হাসল, “আমায় কে বিয়ে করবে! আমার চালচুলো নেই! পার্টি করি সারাক্ষণ। দূর! তবে কী জানিস, কেয়াকে দেখার পরে আর কাউকে ভালও লাগেনি।”
নিশান হেসে বলল, “স্বাভাবিক তো। পাগল আর পাগলি! ভাল হত কিন্তু।”
বিজনদা হাসল। বলল, “তবে রে। আমি তোর জ্যাঠার বয়সি! আমায় দাদা বলিস ঠিক আছে। কিন্তু এসব কী কথা?”
নিশান হেসে বলল, “খুব খারাপ লাগছে কি! তোমরা এই বয়সে কিন্তু কাঁপিয়ে দিচ্ছ! আবার পুরনো দিন আসবে ফিরে।”
বিজনদা এবার হাসল। তবে বিষণ্ণভাবে। বলল, “না রে নিশান, যা যায় তা আর আসে না। আমাদের সেই সময়টা অদ্ভুত ছিল। পরিতোষ, আমি, পেখমদি, কাজুদা। সে এক অন্য সময়।”
নিশান কী বলবে বুঝতে পারল না।
বিজনদা বালিশের ওপর রাখা ফোনটা নিয়ে নাড়াচাড়া করল একটু। তারপর মাথা নাড়ল, “সব কেমন হয়ে গেল রে! কেমন যেন হয়ে গেল!”
“তুমি আমায় কিছু বলতে?” নিশান জিজ্ঞেস করল, “আসলে বাড়িতে ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি! তাই…”
“তুই চাস সোনাঝুরি আবার আগের মতো হোক? চাস?” বিজনদা ফোনটা রেখে প্রশ্ন করল।
নিশান অবাক হয়ে তাকাল বিজনদার দিকে, “হ্যাঁ চাই। কিন্তু পুঁজিপতিদের…”
“বাজে কথা রাখ! জুট মিলের অবস্থা জানিস? যে-কোনও দিন বন্ধ হয়ে যাবে। জোনাক-বাড়িটা দেখেছিস? কেমন হয়ে গেছে। তুই চাস না এগুলোর সংস্কার হোক? চাস না? কেন ঝামেলা করছিস?” বিজনদা মাথা নাড়ল, “এমন করিস না বাবু। তুই তো বুঝদার ছেলে। কী হয়েছে তোর? কে বলেছে তোকে সব ভেঙে বাড়ি হয়ে যাবে? শোন, সেই কোম্পানিটা আর এই কাজে নেই। ওরা সরে গিয়েছে। রিকো গ্রুপের প্ল্যান এমন নয়। আমি জানি সবটা। ওরা এসেছিল আমার কাছে।”
নিশান বলল, “আর তুমি বিশ্বাস করলে? ওরা যে সবকিছু নেওয়ার পরে অন্য কিছু করবে না সেটা হতে পারে তো!”
“না, হবে না,” বিজনদা বলল, “ওরা একটা অ্যাডভাইসরি বোর্ড তৈরি করবে। আমায় থাকতে বলেছে। আমি বলেছি তোকেও রাখতে। আমরা দেখব ওরা যা প্ল্যান এখন বলছে, সেটাই যেন ইমপ্লিমেন্টেড হয়। ওদের ব্রোশার-লিফলেট সব তৈরি। তুই একটু ব্যাপারটা ভাব। পরে যদি ভুলভাল কিছু করতে যায়, সে না হয় আমরা তখন কাজ করতে দেব না! কিন্তু এভাবে তুই উন্নয়নকে আটকাতে যাস না। মিলটা বড় হবে। জোনাক-বাড়িতে ভাল হোটেল আর পার্ক হবে। সোনাঝুরির অর্থনৈতিক লেভেলটা বাড়বে। তুই একটু ভাব।”